ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ

ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ

পদার্থবিদ্যার জগতে অনিশ্চয়তার নীতি প্রবর্তন করে আবিশ্ব বিখ্যাত হয়ে আছেন জার্মান পদার্থবিদ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ (Werner Heisenberg)। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক এবং আইনস্টাইনের তৈরি করা কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যে হাইজেনবার্গের হাত ধরেই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার যাত্রাপথ সূচিত হয়েছিল। ১৯২৭ সালে তাঁর এই অনিশ্চয়তার নীতি প্রকাশ পাওয়ার পর কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৩২ সালে পদার্থবিদ্যায় তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযিদ্ধ চলাকালীন তিনি জার্মানির পরমাণু বোমা আবিষ্কার প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। তাঁরই হাতে জার্মানির মিউনিখ এবং কার্লশ্রুহে-তে বসানো নিউক্লিয় রি-অ্যাক্টরের কারিগরি সাফল্য নিশ্চিত হয় ১৯৫৭ সালে। এছাড়াও ‘কাইসার উইলহেল্ম ইন্সটিটিউট ফর ফিজিক্স’, ‘ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর ফিজিক্স’ প্রভৃতি সংস্থায় অধ্যাপনা করেছেন তিনি। জার্মান রিসার্চ কাউন্সিলের সভাপতি পদেও আসীন হয়েছিলেন তিনি।

১৯০১ সালের ৫ ডিসেম্বর জার্মানির ওয়াজুরবার্গে ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম ওয়ার্নার কার্ল হাইজেনবার্গ। তাঁর বাবা ড. অগাস্ট হাইজেনবার্গ ছিলেন একজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ধ্রুপদি ভাষার শিক্ষক এবং তাঁর মায়ের নাম অ্যানি ওয়েকলেইন। তাঁর বাবা পরবর্তীকালে জার্মানিতে মধ্যযুগ এবং আধুনিক গ্রিক ভাষার ‘অর্ডেনিলেয়াস অধ্যাপক’ পদে আসীন হন। ছোটোবেলা থেকেই একজন লুথেরান খ্রিস্টান হিসেবে তিনি বড় হয়ে ওঠেন। তাঁর কৈশোরের শেষ ভাগে বাভারিয়ার আল্পস পার্বত্য অঞ্চলে ট্রেক করার সময়ে প্লেটোর ‘টাইমাস’ বইটি পড়ে ফেলেন হাইজেনবার্গ। এই বইটি পড়েই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দার্শনিক চিন্তার প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি। আধুনিক বিশ্বে যাকে পরমাণু বলা হয় তার যে কোন বাস্তব অস্তিত্ব নেই, এমন এক জটিল ধারণায় দার্শনিকভাবে উন্নীত হন তিনি এবং সেই কারণে আধুনিক পরমাণুবিজ্ঞানের সঙ্গে প্লেটোর তত্ত্বের মিল খুঁজে পান হাইজেনবার্গ তাঁর কৈশোরেই। ১৯১৯ সালে ‘ফ্রেইকর্পস’ নামের এক আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য হয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে মিউনিখে আসেন তিনি। পরবর্তীকালে ১৯৩৭ সালে এলিজাবেথ স্কুম্যাঙ্কারকে বিবাহ করেন এবং তাঁদের সাত সন্তান নিয়ে তারপর থেকে মিউনিখেই থাকতে শুরু করেন হাইজেনবার্গ।

মিউনিখের ম্যাক্সিমিলিয়ান স্কুলেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় এবং ১৯২০ সালে তিনি পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়ার জন্য ভর্তি হন মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে হাইজেনবার্গ শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন সমারফেল্ড, ওয়েইন, প্রিঙ্গশেম, রোসেনথাল প্রমুখ বিখ্যাত সব বিজ্ঞানীদের। ১৯২২-১৯২৩ সাল নাগাদ শীতকালে গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পদার্থবিদ্যা পড়তে যান ম্যাক্স বর্নের অধীনে। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৩ সালে হাইজেনবার্গ তাঁর গবেষণা সম্পন্ন করেন। তাঁর এই গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন সমারফেল্ড। ১৯২২ সালের জুন মাসে সমারফেল্ডের সঙ্গে গটিনজেনে ‘বোর উৎসব’-এ যোগ দেন হাইজেনবার্গ এবং এই সূত্রেই নিলস বোরের পরমাণুবিদ্যার তত্ত্বগুলির উপর আকৃষ্ট হন তিনি। হাইজেনবার্গ সেই প্রথম বোরের সঙ্গে দেখা করেন। সেই উৎসবে নিলস বোর যে কোয়ান্টাম পরমাণু পদার্থবিদ্যার উপর দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা হাইজেনবার্গের মনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল। গটিনজেনের জর্জ অগাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে এরপরে হাইজেনবার্গ বহিরাগত ছাত্র হিসেবে অধ্যয়ন শুরু করেন পদার্থবিদ্যা আর গণিত বিষয়ে। ম্যাক্স বর্ন, জেমস ফ্রাঙ্কের কাছে পদার্থবিদ্যা এবং ডেভিড হিলবার্টের কাছে গণিতের শিক্ষালাভ করতে থাকেন তিনি। মিউনিখে আবার তাঁকে ফিরে যেতে হয় ১৯২৩ সাল নাগাদ ডক্টরেট পরীক্ষার জন্য। সমারফেল্ডের পরামর্শে পিএইচডির জন্য উদস্থিতিবিদ্যা (Hydrodynamics)-র বিষয়ে গবেষণা করেন এবং তাঁকে চার ঘন্টার গবেষণাগার পরীক্ষায় বসতে বলেন অধ্যাপক উইলি ভিন টাস্ক। এদিকে মৌখিক পরীক্ষায় কিছুতেই তিনি ভাল ফল করতে পারছিলেন না। গবেষণাগার পরীক্ষা চলাকালীন ‘ঘূর্ণন গতিপ্রবাহ’ (Turbulent Flow)-এর বিষয়ে একটি দুঃসাহসী প্রবন্ধও লিখে ফেলেন হাইজেনবার্গ যা পরবর্তীকালে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালে ছাপা হয়েছিল। সমস্ত কোর্সে দুর্দান্ত ফল করলেও গবেষণার পরীক্ষায় কিছুতেই আশানুরূপ ফল করতে না পারায় হতাশ হয়ে ম্যাক্স বর্নের কাছে চলে যান হাইজেনবার্গ। ১৯২৪ সালে ম্যাক্স বর্নের অধীনে হাইজেনবার্গ তাঁর ‘হ্যাবিলিটেশন’ কোর্স শেষ করেন যার মাধ্যমে সেকালে ইউরোপীয় যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর যোগ্যতা অর্জন করা যেত। এই কোর্সে ‘জিম্যান প্রভাব’ বিষয়ে তিনি একটি থিসিস রচনা করেন।


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

ঠিক এর পরের বছর জুন মাস নাগাদ নীলস বোরের পরমাণু তত্ত্বের মধ্যে ইলেকট্রনের ঘূর্ণনের অমীমাংসিত সমস্যাটির ব্যাপারে ভাবতে ভাবতে হাইজেনবার্গ অভিনব এক তাত্ত্বিক ব্যাখা আবিষ্কার করে ফেলেন। হাইজেনবার্গ লক্ষ্য করেন যে কোন একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে ইলেক্ট্রনের ভরবেগ ও অবস্থানের গুণফল আর ঠিক উল্টোটা অর্থাৎ ইলেক্ট্রনের অবস্থান ও ভরবেগের গুণফল কিছুতেই মিলছে না। গণিতশাস্ত্রে ম্যাট্রিক্স-এ এর একটা সমাধান পাওয়া যেতে পারে এবং এই সমস্যার সূত্র ধরেই ম্যাক্স বর্ন এবং পাসকুয়াল জর্ডানের সঙ্গে একত্রে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নতুন এক শাখার জন্ম দেন হাইজেনবার্গ। এই অভিনব শাখার নাম ছিল ‘ম্যাট্রিক্স মেথড’। এর পরে এই যে ইলেক্ট্রনের অবস্থান ও ভরবেগের পরিমাপের অসমতা বা একই মুহূর্তে এই দুই রাশির ভিন্নতা সেই ধারণা থেকেই হাইজেনবার্গ তাঁর অবিস্মরণীয় তত্ত্ব সৃষ্টি করেন যার নাম ‘অনিশ্চয়তার নীতি’। এই নতুন তত্ত্বের জন্য ১৯৩২ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ। এই অনিশ্চয়তার নীতি অনুযায়ী কোনো পারমাণবিক কণার ভরবেগ ও অবস্থান একইসঙ্গে নিখুঁতভাবে গণনা করা সম্ভব নয়। এই ধারণা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ধারণাকে আরো শক্তিশালী করে। এই নীতি অনুযায়ী এও স্বীকার করে নেওয়া হয় যে, পারমাণবিক ইলেক্ট্রন, প্রোটন বা অন্যান্য কণার একইসঙ্গে তরঙ্গ ধর্মও আছে, আবার কণা ধর্ম আছে। এর মধ্যে ১৯২৬ সালে নিলস বোরের অধীনে কোপেহাগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক পদে যুক্ত হন হাইজেনবার্গ এবং মাত্র ২৭ বছর বয়সে লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৪১ সালে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক পদে এবং একই বছরে কাইসার উইলহেল্ম ইন্সটিটিউট ফর ফিজিক্সে ডিরেক্টর পদে বহাল হন তিনি।

অনিশ্চয়তার নীতিই হোক বা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ধারণাই হোক, এর বাইরে হাইজেনবার্গের পরিচিতির আরেকটি কারণ হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে জার্মানির পরমাণু বোমা আবিষ্কারের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। এর কিছুদিন আগে নাৎসি জার্মানির ইহুদি নিধন যজ্ঞের সমালোচনা করে হিটলারের প্রবল প্রতাপকে উপেক্ষা করে হাইজেনবার্গ বলেছিলেন যে একজন শিক্ষক বা অধ্যাপক ইহুদি হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে অধ্যাপনা করতে দেওয়া উচিত। এই মন্তব্যে হিটলার শাসিত জার্মানিতে আলোড়ন দেখা দেয়, চাকরিক্ষেত্রে পদোন্নতি স্থগিত হয়ে যায় তাঁর। এমনকি গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্রও চলতে থাকে হাইজেনবার্গের বিরুদ্ধে। এই ঘটনার পরে ১৯৩৯ সাল নাগাদ নাৎসি জার্মানিতে পরমাণু বোমা নির্মাণের পরিকল্পনায় হিটলারের আহ্বানে হাইজেনবার্গ জার্মানির নিউক্লিয় গবেষক দল ‘ইউরেনিয়াম ক্লাব’-এ যোগ দেন। হাইজেনবার্গের উদ্যোগে পরমাণু বোমা নির্মাণের একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেলেও বোমা বানাতে সক্ষম হননি তিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগের নজরদারির কারণে ইউরেনিয়াম ক্লাবের সব বিজ্ঞানী ধরা পড়ে যান। ১৯৪৫ সালের ১ জুন জার্মানির পরমাণু বোমা প্রকল্পের স্থান থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করে ইংল্যাণ্ডে কেমব্রিজের কাছে ‘ফার্ম হল’ নামক একটা পরিত্যক্ত ঘরে বন্দি করে রাখা হয় হাইজেনবার্গ ছিলেন যাঁদের মধ্যে একজন। ১৯৪৬ সালের ৩ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হাইজেনবার্গ সহ অন্যান্য সকল বন্দি বিজ্ঞানীদের মুক্তি দেয়।

এরপর ১৯৪৮ সালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউটে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপনা শুরু করেন হাইজেনবার্গ। আলেকজাণ্ডার ভন হামবোল্ট ফাউণ্ডেশনের সভাপতি পদে অভিষিক্ত হন হাইজেনবার্গ ১৯৫৩ সালে। ১৯৫৫-৫৬ সাল নাগাদ স্কটল্যাণ্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ে জিফর্ড লেকচারার হিসেবে বেশ কিছু বক্তৃতা দেন তিনি। ১৯৫৭ সালের পর থেকে প্লাজমা পদার্থবিদ্যা এবং তাপ-নিউক্লীয় প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও গভীরে গবেষণা শুরু করেন হাইজেনবার্গ। জেনেভার ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ অ্যাটমিক ফিজিক্স’ সংস্থায় বেশ কিছুদিন তিনি সায়েন্টিফিক পলিসি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। পদার্থবিদ্যার জটিল জগত ছাড়াও উচ্চাঙ্গ ধ্রুপদি সঙ্গীত চর্চা ছিল তাঁর অন্যতম প্রধান শখ। তিনি নিজে একজন দক্ষ ও কুশলী পিয়ানোবাদক ছিলেন।

নোবেল পুরস্কার ছাড়াও ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয়, কার্লশ্রুহে বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুদাপেস্ট বিশ্ববিদ্যালয় হাইজেনবার্গকে সম্মানীয় ডক্টরেট উপাধিতে ভূষিত করেছে। এছাড়া অর্ডার অফ মেরিট অফ বাভারিয়া, গ্র্যাণ্ড ক্রস ফর ফেডেরাল সার্ভিসেস উইথ স্টার ইত্যাদি সম্মানও অর্জন করেছেন তিনি।

১৯৭৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কিডনির ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের মৃত্যু হয়।

One comment

আপনার মতামত জানান