বিমলা মন্দির

বিমলা মন্দির ভ্রমণ

বিমলা মন্দির হল চার আদি শক্তিপীঠের অন্যতম পীঠ। পুরীর জগন্নাথ মন্দির চত্বরে অবস্থিত বিমলা মন্দিরের গুরুত্ব তান্ত্রিক ও শাক্তদের কাছে জগন্নাথ মন্দিরের থেকেও বেশি। শুধু তাই নয়, শাক্তদের বিশ্বাস অনুযায়ী বিমলাদেবী হলেন পুরীর শক্তিপীঠের প্রধান দেবী এবং জগন্নাথের তান্ত্রিকা পত্নী। প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকে। ভৈরব শিবের রূপ হলেও বিমলা মন্দিরে জগন্নাথকে তাঁর ভৈরব বলে মনে করা হয়।

বিমলা মন্দির পুরীর সমুদ্র সৈকত থেকে মাত্র তিন কিমি দূরের জগন্নাথ মন্দির চত্বরের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে অবস্থিত। পুরী স্টেশন থেকেও মন্দিরের দূরত্ব তিন কিমির মধ্যেই।

জগন্নাথ মন্দির
বিমলা মন্দির। ছবি ইন্টারনেট।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন।  সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। “দেবীপুরাণ” মতে বিমলা মন্দিরে সতীর পা পড়েছিল। অন্যমতে এখানে সতীর নাভি পড়েছিল। এই নিয়ে নানা মতভেদ আছে।

বিমলা মন্দির প্রধান মন্দির জগন্নাথ দেবের মন্দিরের থেকেও পুরনো বলে মনে করা হয়। এর পাশে রয়েছে “রোহিণী কুন্ড” নামে পবিত্র একটি জলাধার। মন্দিরের চারটি অংশ বর্তমান। প্রথমটি বিমান অর্থাৎ গর্ভগৃহ সম্বলিত অংশ। দ্বিতীয়টি জগমোহন অর্থাৎ সভাকক্ষ। তৃতীয়টি নাট মণ্ডপ অর্থাৎ উৎসব কক্ষ। চতুর্থটি হল ভোগ মণ্ডপ অর্থাৎ ভোগ নিবেদনের কক্ষ। দেবী বিমলার মূর্তি কেন্দ্রীয় গর্ভগৃহে রাখা আছে। মূর্তির উচ্চতা ৪ ফুটের কিছু বেশি এবং দেবীমূর্তিটি চতুর্ভূজা। মন্দিরটি ২০০৫ সালে সংস্কার করা হয়েছে এবং বর্তমানে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ভুবনেশ্বর শাখা এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষন করে থাকে।

এই মন্দিরে বিমলাদেবীর জন্য আলাদা করে ভোগ রান্না করা হয় না। জগন্নাথকে নিবেদন করা ভোগই বিমলা দেবীকে নিবেদন করা হয়। তারপর সেটা মহাপ্রসাদের মর্যাদা পায়। জগন্নাথের উচ্ছিষ্ট বিমলাদেবীকে দেওয়ার পিছনে একটি পৌরাণিক কাহিনী আছে। শিব একসময় বৈকুণ্ঠে বিষ্ণুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেই সময় বিষ্ণু খাচ্ছিলেন। তার খাবারের কিছু অংশ মাটিতে পড়ে গেলে শিব তা কুড়িয়ে নিজে খান। সেই খাবার শিবের মুখের বাইরে লেগে ছিল। শিব কৈলাশে ফিরলে নারদ শিবের সাথে দেখা করতে আসেন, আর শিবের মুখে বিষ্ণুর উচ্ছিষ্ট লেগে আছে দেখে বিষ্ণুভক্ত নারদ তা খেয়ে নেন। এই বিষয়টি পার্বতীর চোখে পড়লে তিনি বিষ্ণুকে নালিশ করে বলেন ,তিনি বিষ্ণুর প্রসাদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তখন বিষ্ণু পার্বতীকে শান্ত করে বলেছিলেন কলিযুগে তিনি বিমলারূপে নিত্য তার প্রসাদ পাবেন।

বিমলা মন্দির ঘুরতে গেলে আসতে হবে পুরী। প্লেনে এলে ভুবনেশ্বর বিমানবন্দরে নামতে হবে। ভুবনেশ্বর বিমানবন্দর থেকে পুরী প্রায় ৫৫ কিমি দূরে। ট্রেনে করে আসতে চাইলে সবথেকে ভালো হয় হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে রাতের ট্রেনে পুরী স্টেশন। তারপর ট্যাক্সি বা হোটেলের গাড়ি করে হোটেলে যাওয়া যায়। স্টেশন থেকে মন্দিরের দুরত্ব ৩ কিমি। ২০২১ সালের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সরাসরি পুরী স্টেশন অবধি কয়েকটি ট্রেনের বিস্তারিত তুলে ধরা হল।

ট্রেন নাম্বারট্রেনের নামকোথা থেকে ছাড়বেকখন ছাড়বেপুরী কখন পৌঁছবেকোন দিন চলে
০২৮৩৭হাওড়া পুরী ফেস্টিভাল স্পেশাল হাওড়ারাত ১০টা ৩৫ মিনিটসকাল ৭টা ১০ মিনিটসবদিন
০২০৮৭ধৌলি এসএফ স্পেশাল হাওড়াসকাল ৯টা ১৫ মিনিটসন্ধ্যে ৬টাসবদিন
০২২০১শিয়ালদহ পুরী দুরন্ত কোভিড - ১৯
স্পেশাল
শিয়ালদহরাত ৮টাভোর ৩টে ৫৫ মিনিটসোম, শুক্র

কলকাতা, দুর্গাপুর থেকে সরাসরি বাসেও পুরী আসা যায়।

বিমলা মন্দিরের কাছে থাকার জন্য বহু হোটেল, রিসোর্ট, গেস্ট হাউস, হলিডে হোম রয়েছে। হোটেলের ভাড়া প্রতিরাতে ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০০০ টাকা অবধি রয়েছে। বেশ কিছু হলিডে হোমে নিজেদের রান্না করার ব্যবস্থাও আছে। এই মন্দিরের থেকে মাত্র ২ কিমির মধ্যে স্বর্গদ্বারের হোটেলগুলোতে থাকলে সুবিধা। শুধুমাত্র মন্দির থেকে কাছে বলেই নয়, এখানে থাকলে কাছাকাছিই আছে বাজার, যেখান থেকে সবজি ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের মাছ, সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি এসব কিনে আনতে পারেন। তারপর নিজেরা বা রান্নার লোক দিয়ে রান্না করাতে পারেন।

মন্দির চত্বরে বিমলা মন্দির ছাড়াও রয়েছে আরও অনেকগুলো মন্দির। তাদের মধ্যে প্রধান মন্দির অবশ্যই জগন্নাথ মন্দির। জগন্নাথ মন্দির হিন্দুদের চারধামের একটি ধাম। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী শ্রীবিষ্ণু রামেশ্বরমে স্নান করে বদ্রীনাথে ধ্যান করেন, তারপর পুরীতে জগন্নাথ মন্দিরে খাবার খেয়ে দ্বারকায় বিশ্রাম করেন। অন্যান্য মন্দিরগুলো হল মহালক্ষ্মী মন্দির, বটগণেশ মন্দির, নবগ্রহ মন্দির, নরসিংহ মন্দির, গোপীনাথ মন্দির এবং ছোটবড় মন্দির মিলিয়ে আরও বেশ কয়েকটা মন্দির। শাক্তদের কাছে বিমলা জগন্নাথের স্ত্রী হলেও জগন্নাথের বিষ্ণুরূপের স্ত্রী দেবী লক্ষ্মী অবস্থান করেন মহালক্ষ্মী মন্দিরে। ভক্তদের বিশ্বাস অনুযায়ী, জগন্নাথেরা রথযাত্রায় তিন ভাইবোন গুণ্ডিচার বাড়ি গেলেও দেবী মহালক্ষ্মী তাঁর মন্দিরেই থাকেন। তারপর তিনি গুণ্ডিচার বাড়ি এসে জগন্নাথকে নিজের বাড়ি ফিরতে অনুরোধ করেন এবং রথের একখানি কাঠ ভেঙে নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের পরে প্রথমে বটগণেশের পূজা করা হত। তার পাশেই আছে ‘কল্পবট’ নামক পবিত্র বটগাছ। এই গাছে সুতো বেঁধে ভক্তেরা মানত করে। ফণী ঝড়ের পাল্লায় এই গাছের অনেকটা ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয়দের মতে জগন্নাথ মন্দিরের রান্নাঘর বিশ্বের বৃহত্তম রান্নাঘর, যেখানে প্রতিদিন কয়েক হাজার ভক্ত ভোজন করে। তবে রান্নাঘরে সাধারণের প্রবেশের অনুমতি নেই। বাইরে থেকেই দর্শন করতে পারবেন।

মহাপ্রসাদ
আনন্দবাজারে মহাপ্রসাদ বিক্রি। ছবি ইন্টারনেট

এছাড়াও মন্দিরের কাছেই ঘুরে দেখুন পুরীর সমুদ্র, স্বর্গদ্বার, জগন্নাথের মাসির বাড়ি, জগন্নাথের পিসির বাড়ি, লাইট হাউস, পুরীর মোহনা, গম্ভীরা, সুদর্শন পট্টনায়ক স্যান্ড আর্ট ইনস্টিটিউট, সুদর্শন ক্রাফট মিউজিয়াম।

সারা বছর ধরেই এখানে ঘুরতে আসা যায়। রথযাত্রার সময় জগন্নাথ,বলরাম, সুভদ্রার রথ টানতে লক্ষাধিক ভক্তের ভিড় হয়। সেই সময় যেতে চাইলে অনেক আগে থেকে সব বুকিং করে রাখতে হবে।

মন্দিরে এলে মহাপ্রসাদ খেয়ে দেখুন। মন্দির চত্বরের উত্তর পূর্ব কোণে আছে আনন্দবাজার। এখানে মহাপ্রসাদ বিক্রি হয়। এখান থেকে ভক্তেরা মহাপ্রসাদ কিনে বাড়ি ফিরে এসে সেই প্রসাদ সকলে নিজের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের দেয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এই প্রসাদ খেলে অন্তরাত্মা পবিত্র হয়, পাপনাশ হয়, রোগব্যাধি দূর হয়।

মন্দির চত্বরে জুতো পরে প্রবেশ নিষেধ, ভিতরে ছবি তোলা নিষেধ। মোবাইল ও চামড়ার জিনিস নিয়ে যাওয়াও নিষেধ। দিনের কোন সময় মন্দির খোলা থাকে তা হোটেল থেকে বা স্থানীয়দের সাথে কথা বলে আগে থেকে জেনে নেবেন। মন্দিরে এখানে পাণ্ডাদের উৎপাত কম হলেও রয়েছে। তবে ওদের সাথে তর্ক করবেন না। ওদের এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করুন। বিকেলে মন্দির খোলার পরপরই ভিড় কম থাকে। সেই সময় অনেক ভালোভাবে পুরো মন্দির চত্বরে ঘোরা যায়।


ট্রিপ টিপস

  • কিভাবে যাবেন – বিমলা মন্দির ঘুরতে গেলে আসতে হবে পুরী। প্লেনে এলে ভুবনেশ্বর বিমানবন্দরে নামতে হবে। ভুবনেশ্বর বিমানবন্দর থেকে পুরী প্রায় ৫৫ কিমি দূরে। ট্রেনে করে আসতে চাইলে সবথেকে ভালো হয় হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে রাতের ট্রেনে পুরী স্টেশন। তারপর ট্যাক্সি বা হোটেলের গাড়ি করে সরাসরি হোটেলে যাওয়া যায়। এছাড়া কলকাতা, দুর্গাপুর থেকে সরাসরি বাসেও পুরী আসা যায়।
  • কোথায় থাকবেন – বিমলা মন্দিরের কাছে থাকার জন্য বহু হোটেল, রিসোর্ট, গেস্ট হাউস, হলিডে হোম রয়েছে। হোটেলের ভাড়া প্রতিরাতে ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০০০ টাকা অবধি রয়েছে। মন্দিরের থেকে মাত্র ২ কিমির মধ্যে স্বর্গদ্বারের হোটেলগুলোতে থাকলে সুবিধা।
  • কি দেখবেন – মন্দির চত্বরে দেখুন জগন্নাথ মন্দির, বিমলা মন্দির, মহালক্ষ্মী মন্দির, বটগণেশ মন্দির, নরসিংহ মন্দির, বটগণেশ, আনন্দবাজার ইত্যাদি। এছাড়াও মন্দিরের কাছেই ঘুরে দেখুন পুরীর সমুদ্র, স্বর্গদ্বার, জগন্নাথের মাসির বাড়ি, জগন্নাথের পিসির বাড়ি, লাইট হাউস, পুরীর মোহনা, গম্ভীরা, সুদর্শন পট্টনায়ক স্যান্ড আর্ট ইনস্টিটিউট, সুদর্শন ক্রাফট মিউজিয়াম।
  • কখন যাবেন – সারা বছর ধরেই এখানে ঘুরতে আসা যায়। রথযাত্রার সময় যেতে চাইলে অনেক আগে থেকে সব বুকিং করে রাখতে হবে।
  • সতর্কতা
    • মন্দিরের ভিতরে জুতো পরে প্রবেশ নিষেধ, ভিতরে ছবি তোলা নিষেধ। মোবাইল ও চামড়ার জিনিস নিয়ে যাওয়াও নিষেধ।
    • দিনের কোন সময় মন্দির খোলা থাকে তা হোটেল থেকে বা স্থানীয়দের সাথে কথা বলে আগে থেকে জেনে নেবেন।
  • বিশেষ পরামর্শ
    • বিকেলে মন্দির খোলার পরপরই ভিড় কম থাকে। সেই সময় পুরো মন্দির চত্বরে ভালোভাবে ঘোরা যায়।

বিমলা সতীপীঠ নিয়ে বিস্তারিত জানতে শুনুন এখানে

তথ্যসূত্র


  1. নিজস্ব প্রতিনিধি
  2. https://www.kolkata24x7.com/
  3. https://www.eimuhurte.com/
  4. https://indiarailinfo.com/

আপনার মতামত জানান