সুভাষ মুখোপাধ্যায়

ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়

সুভাষ মুখোপাধ্যায় (Subhash Mukhopadhyay) একজন ভারতীয় বাঙালি চিকিৎসাবিজ্ঞানী যিনি পৃথিবীর দ্বিতীয় এবং ভারতের প্রথম টেস্টটিউব বেবি কানুপ্রিয়া আগরওয়াল (দুর্গা)-র জন্মদানের কৃতিত্বের অধিকারী। তাঁর এই যুগান্তকারী আবিষ্কার সত্ত্বেও তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবহেলায় তাঁর এই অসামান্য কৃতিত্বের খবর আন্তর্জাতিক মহলে পৌঁছাতে পারেনি। দুর্ভাগ্যবশত নানা দিক থেকে প্রতিবন্ধকতায়-অসম্মানে-অন্তর্ঘাতে যোগ্য স্বীকৃতি না পেয়ে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাঙালির বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় এক ট্র্যাজিক ইতিহাসের স্রষ্টা।

১৯৩১ সালের ১৬ জানুয়ারি হাজারিবাগে ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। ডাঃ সুভাষ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৯ সালে ফিজিওলজি নিয়ে বি.এস.সি পাশ করেন। এরপর ১৯৫৫ সালে কলকাতা জাতীয় মেডিকেল কলেজ থেকে তিনি গাইনোকোলজি বিষয়ে প্রথম হয়ে এম.বি.বি.এস পাশ করেন এবং হেমাঙ্গিনী বৃত্তি লাভ করেন। এরপর রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে তিনি ১৯৫৮ সালে প্রজননিক শারীরবিদ্যায় (Reproductive Physiology) পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ১৯৬৭ সালে তিনি জন লোরেনের সঙ্গে হরমোন সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণা করেন এবং ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরা (University of Edinburgh) থেকে দ্বিতীয়বার  রিপ্রোডাকটিভ এন্ডোক্রিনোলজিতে (Reproductive endocrinology) ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। বিদেশে এরপর আরও গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার এবং একইসাথে চাকরি করার সুযোগ পেলেও সেইসব সুবর্ণ সুযোগ ছেড়ে দিয়ে তিনি কলকাতায় চলে আসেন।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কর্মজীবন শুরু হয় কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে ফিজিওলজির অধ্যাপক হিসেবে। তিনি এখানে ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। ডাক্তারি অভ্যাস করার থেকে তিনি গবেষণা করতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন এবং অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি তাঁর গবেষণার কাজ চালিয়ে যান। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল “ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন” (In-Vitro Fertilisation) যা সেইসময় ভারতবর্ষের এক যুগান্তকারী আবিষ্কার । ১৯৭৮ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অন হরমোনাল স্টেরয়েডস’-এ এবং ১৯৭৯ সালে হায়দ্রাবাদে ‘ইণ্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস’-এ তিনি তাঁর এই আবিষ্কার সম্পর্কে আলোকপাত করেন। তাছাড়া ১৯৭৯ সালেই ‘ইণ্ডিয়ান জার্নাল অফ ক্রায়োজেনিক্স’-এ একটি গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেন এই বিষয়ে। পরবর্তীকালে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে নমিতা মুখোপাধ্যায়ের বিবাহ হয়। একটি সূত্র থেকে জানা যায় যে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাজের ব্যাঘাত হতে পারে বলে তারা কখনও সন্তান ধারণের কথা ভাবেননি।

ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন পদ্ধতিতে টেস্টটিউব বেবির জন্মদান নিঃসন্তান দম্পতিদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। এটি হল এমন এক জটিল প্রক্রিয়া যার সাহায্যে মাতৃ-জরায়ুর বাইরে ডিম্বাশয়টি শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয় এবং তার পরে সেই নিষিক্ত ডিম্বাণুটি জরায়ুতে রোপণ করা হয়। বর্তমান সময়ে উন্নত প্রথম বিশ্বের দেশগুলির পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশেও নিঃসন্তান দম্পতিরা টেস্টটিউব পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তান ধারণ করতে সক্ষম হন। ১৯৭৮ সালে লন্ডনে রবার্ট এডওয়ার্ডসের গবেষণার ফলে জন্ম হয় বিশ্বের প্রথম টেস্ট টিউব বেবি লুইস ব্রাউনের। এর মাত্র ৬৭ দিন পর ৩ অক্টোবর ভারতে ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে জন্ম নেয় টেস্টটিউব বেবি ‘দুর্গা’র। কানুপ্রিয়া আগরওয়াল বা ‘দুর্গা’ বিশ্বের দ্বিতীয় এবং ভারতের প্রথম টেস্টটিউব শিশু। এই দীর্ঘ গবেষণার কাজে ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে সাহায্য করেছিলেন ক্রায়োবায়োলজিস্ট ডাঃ সুনীত মুখোপাধ্যায় এবং গাইনোকোলজিস্ট ডাঃ সরোজকান্তি ভট্টাচার্য। সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে গিয়ে তাঁর কাজে সাফল্য পেতে হয়েছে। অর্থের সমস্যা থেকে শুরু করে অপর্যাপ্ত পরিকাঠামোর সমস্যা, সহকর্মীদের অসহযোগিতা এবং ঈর্ষা সবই তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। দুর্গার জন্মের সময় তিনি দুর্গার মা বেলা আগরওয়ালের শরীরে যৌন হরমোন প্রয়োগ করেন। তারপর একাধিক ডিম্বাণু সংগ্রহ করে তৈরি করেন ভ্রূণকোষ এবং সেগুলিকে স্থাপন করেন মায়ের গর্ভে। এর আগে তিনি পাঁচটি ভ্রূণ তরল নাইট্রোজেনে ৫৩ দিন হিমায়িত রাখেন। 

গবেষণায় এত বড় সাফল্য পাওয়ার পরেও তিনি তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু পাননি। তাঁর গবেষণার সত্যতা যাচাই করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি তদন্ত কমিটি তৈরি করে। সবদিক খতিয়ে দেখে সেই কমিটি রায় দেয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণার কোন বাস্তব ভিত্তি বা সত্যতা কিছুই নেই। অনেকে মনে করেন এর পেছনে তখনকার প্রভাবশালী অনেক চিকিৎসকের হাত ছিল যাঁরা তাঁর সাফল্যের প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে তাঁর ক্ষতি করতে চেয়েছিলেন। এরপর তাঁকে জোর করে চক্ষু বিভাগে বদলি করে দেওয়া হয়। দিনের পর দিন তাঁর ওপর নানা দিক থেকে চাপ সৃষ্টি করা হয়। ১৯৭৯ সালে জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের (Kyoto University) প্রাইমেট রিসার্চ সেন্টার (Primate Research Centre) থেকে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয় সেখানে গিয়ে তাঁর গবেষণা সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য। কিন্তু ভারত সরকার তাঁকে জাপান যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। এরপরে তিনি একবার হৃদরোগেও আক্রান্ত হন। কিন্তু সেই সময় কিছুদিনের ছুটির জন্য দরখাস্ত করেও তিনি সেই ছুটি পাননি। একটা সময় তাঁকে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুমতি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।

১৯৮১ সালের ১৯ জুন মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে সুভাষ মুখোপাধ্যায় আত্মহত্যা করেন।

তাঁর মৃত্যুর পরে ভারতের দ্বিতীয় টেস্ট টিউব বেবি হর্ষের জন্মদাতা ডাক্তার টি. সি. আনন্দকুমার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাজকে স্বীকৃতি দিলে সাধারণ মানুষ তাঁর কাজ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে শুরু করে। ১৯৯৭ সালে ডাক্তার কুমার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণার নোটস খুঁজে পান সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রীর সহায়তায় এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করেন। পরে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্মরণে ‘রিপ্রোডাক্টিভ বায়োলজি’ (Reproductive biology) নিয়ে গবেষণা করার জন্য তিনি একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। হাজারিবাগের সদর হাসপাতালে তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে তাঁরই একটি বিশালাকায় মূর্তি স্থাপিত হয়েছে। ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী ‘অভিমন্যু’ নামে একটি উপন্যাস লেখেন। এই উপন্যাস অবলম্বনেই ১৯৯০ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক তপন সিংহ ‘এক ডক্টর কি মউত” নামে একটি হিন্দি চলচ্চিত্র তৈরি করেন যা জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। শাবানা আজমি এবং পঙ্কজ কাপুর সেই ছবিতে অভিনয় করেন। এখন ভারতে প্রায় চারশোরও বেশি ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (In vitro Fertilization)  ক্লিনিক রয়েছে এবং এই পদ্ধতিতে হাজার হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে বর্তমানে। ২০১০ সালে রবার্ট এডওয়ার্ডস তাঁর আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পান। কিন্তু ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব অন্ধকারেই থেকে যায়।

3 comments

আপনার মতামত জানান