মতিউর রহমান

মতিউর রহমান

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ প্রাপক ছিলেন বিমান লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান (Matiur Rahaman)। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিমান উড়িয়ে পাকিস্তানি আক্রমণের পালটা আঘাত হানতে গিয়ে শহীদ হন। মৃত্যুর পরে পাকিস্তানের মাটিতে তাঁকে কবর দেওয়া হয় এবং তাঁর কবরের সামনে ‘বিশ্বাসঘাতকের কবর’ কথাটি লেখা ছিল। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার সেই কবর দেশের মাটিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। পাকিস্তানি হানাদারি পৈশাচিক আক্রমণের বিরুদ্ধে দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে তাঁর প্রত্যাঘাতের প্রয়াস ব্যর্থ হলেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। অসীম সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য বাংলাদেশের যে সাতজনকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেওয়া হয়, তাদের মধ্যে মতিউর রহমান ছিলেন অন্যতম এক শহীদ মুক্তিযোদ্ধা।

১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর বাংলাদেশের পুরানো ঢাকায় ১০৯ নং আগা সাদেক রোডে অবস্থিত মোবারক লজে মতিউর রহমানের জন্ম হয়। নরসিংদীর রায়পুরা থানার অন্তর্গত রামনগর গ্রামে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল। তাঁর বাবার নাম মৌলভী আবদুস সামাদ এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন। তাঁদের এগারোটি সন্তানের মধ্যে ষষ্ঠ সন্তান ছিলেন মতিউর রহমান।

ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলেই মতিউর রহমানের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা সম্পূর্ণ হয়। তবে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে তিনি পড়েছিলেন মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। এরপরে সারগোদায় পাকিস্তানের বিমান বাহিনির পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন তিনি। এই স্কুল থেকে ডিস্টিংশান সহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। ১৯৬১ সালের ১৫ আগস্ট রিসালপুরে ‘পাকিস্তান এয়ার ফোর্স অ্যাকাডেমি’তে ভর্তি হন তিনি। ১৯৬৩ সালের ২২ জুন রিসালপুর পিএএফ কলেজ থেকে পাইলট অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেন মতিউর রহমান।

এরপরে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচির অধুনা মাসরুরে অবস্থিত এয়ার বেসে ২ নং স্কোয়াড্রনে সাধারণ কর্মরত বিমানচালক হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। সেই বেসেই টি-৩৩ জেট বিমান চালানোর জেট কনভার্সন প্রশিক্ষণ শেষ করেন মতিউর। ৭৫.৬৬ শতাংশ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি এই পরীক্ষায় আর তারপরই ফাইটার কনভার্সন প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হন তিনি। এফ-৮৬ স্যাবার জেটবিমানের এয়ারবেসে এই প্রশিক্ষণটি শুরু হয়। এই কোর্সেও ৮১ শতাংশ নম্বর নিয়ে পাশ করেন মতিউর। এই অসাধারণ ফলাফলের জন্য পেশোয়ারের ১৯ নং স্কোয়াড্রনে মতিউর রহমানকে বদলি করা হয়। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালীন তিনি ছিলেন ফ্লাইং অফিসার। সারগোদায় মিগ কনভার্সন কোর্সের জন্য গিয়েছিলেন তিনি। জানা যায় এই সারগোদায় প্রশিক্ষণ চলাকালীন হঠাৎ একদিন মিগ-১৯ বিমান চালানোর সময় আকাশে তা বিকল হয়ে যায় এবং সেই বিপদের মুহূর্তে প্যারাশ্যুট খুলে বিমান থেকে মাটিতে নেমে আসেন মতিউর রহমান। এই সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য যথেষ্ট প্রশংসিত হন তিনি। এরপরে বিমান লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হন তিনি। পেশোয়ারে এক আনুষ্ঠানিক মহড়ায় ইরানের রাণী ফারাহ দিবার সম্মানে একমাত্র বাঙালি পাইলট হিসেবে তাঁর উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৯৭০ সালে জেট ফ্লাইং প্রশিক্ষকের পদে আসীন হন মতিউর। এর আগে যদিও তিনি দুই বছর রিসালপুরে ফ্লাইং প্রশিক্ষকের কাজ করেছেন। ঢাকায় দুই মাসের জন্য পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাতে আসেন মতিউর রহমান।

সময়টা ১৯৭১ সাল। ঐ বছরই ২৫ মার্চ নাগাদ নরসিংদীর রায়পুরার রামনগর গ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ শুরু হয়ে যায়, শুরু হয় যুদ্ধ। নৃশংস পৈশাচিক হত্যালীলা সহ্য করতে পারেননি তিনি। গোপনে অসীম সাহসে ভর করে ভৈরবে একটি প্রশিক্ষণ শিবির খোলেন মতিউর। পদাধিকারে তিনি তখন পাকিস্তান বিমান বাহিনির একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। তাঁর পক্ষে পাকিস্তানের সেনাদের বিরোধিতা করা যথেষ্ট দুঃসাধ্য ছিল। বাঙালি যুবকদের বিমান চালানোর পাশাপাশি আক্রমণ প্রতিহত করার প্রশিক্ষণ দিতে থাকলেন মতিউর। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন স্থান থেকে অস্ত্র-শস্ত্র সংগ্রহ করে আনলে একটি প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি। ঠিক ১৪ এপ্রিল তারিখে পাকিস্তানের ‘সেভর জেড’ বিমান মতিউর রহমান এবং তাঁর প্রতিরোধ বাহিনির ঘাঁটি লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করে। প্রাথমিকভাবে কেউ আহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হননি সেই সময়। তিনি সকলের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন যে এই পাকিস্তানি বোমারু বিমানচালকদের মধ্যে কেউ হয়তো তাঁরই ছাত্র। কিন্তু আজ তারাই তাদের শিক্ষকের উপরে আক্রমন হানছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ভেবে, বাংলাদেশের মুক্তির যুদ্ধে দেশের মাটির সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করার জন্য একটি যুদ্ধবিমানের সন্ধান করতে থাকেন মতিউর। কারণ একমাত্র একটি বিমানের সাহায্যেই অপর একটি বিমানের আক্রমণকে প্রতিহত করা সম্ভব। এই পরিস্থিতিতে করাচিতে ফিরে গেলে মতিউর স্পষ্ট বুঝতে পারেন যে বাঙালি পাইলটদের উপরে প্রবল সন্দেহ করা শুরু হয়েছে বিমানচালক ও অফিসারদের মধ্যে। ৯ মে তারিখে তিনি পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাতে করাচিতে এসে পৌঁছান। করাচিতে কাজে যোগ দিতে চাইলে ফ্লাইং প্রশিক্ষক এবং ফ্লাইং লেফটেন্যান্টের পদ থেকে তাঁকে অপসারিত করে ফ্লাইং সেফটি অফিসারের পদে আসীন করা হয়। শুধুমাত্র বাঙালি হওয়ার কারণে সন্দেহবশে তাঁর এই পদোবনতি ঘটে। এতকিছুর মধ্যেও মতিউরের চিন্তা ছিল একটাই বিমান সংগ্রহ করে তা দিয়ে প্রত্যাঘাত হানা। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও এই চিন্তার কথা কাউকে জানাননি তিনি এবং জানতে দেনওনি। ইতিমধ্যে পিআইএ-র একটি বিমান অপহরণের সংবাদ আসে আর তার ফলে পাকিস্তানি বিমান অফিসার ও অন্যান্য পদাধিকারীদের মধ্যে বাঙালিদের উপর প্রবল সন্দেহ দানা বাঁধতে লক্ষ্য করেন মতিউর রহমান। কড়া নজরদারির মধ্যে দিন কাটতে থাকে তাঁর। এমনকি সমস্ত বাঙালি বিমানচালকদের বিমান উড়ান নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। মতিউর রহমান দায়িত্ব পান করাচির মাশরুর বেস ফ্লাইট সেফটি অফিসারের। তিনি এবারে দৃঢ় সিদ্ধান্তে একজন ছাত্রকে নজর করেন এবং তাঁর সাহায্যেই কাজ হাসিল করার চেষ্টা করতে থাকেন। মতিউরের অনেক পুরোনো ছাত্র রশিদ মিনহাজ। তাঁর আকাশে উড়ানের কোনো বাধা ছিল না বলে মতিউর তাঁকেই লক্ষ্য করে পরিকল্পনার জাল বিছাতে থাকেন। ১৯৭১ সালের ২০ আগস্টই ঘটে যায় সেই অবিশ্বাস্য ঘটনা। রশিদ মিনহাজ নির্দিষ্ট রুটিন অনুযায়ী ফ্লাইটের উড়ান দেন আর ঠিক এই সময়েই বিমানের রানওয়ের বাঁদিক থেকে গাড়ি নিয়ে এসে পড়েন মতিউর রহমান। গাড়ি থেকে নেমে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তিনি রানওয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত তুলে রশিদ মিনহাজের চালানো সেই ব্লু-বার্ড যুদ্ধবিমানটিকে দাঁড় করান। ইশারায় তিনি রশিদকে বোঝানোর চেষ্টা করেন বিমানের পাখায় সমস্যা আছে তাই উড়ানের পরে সমস্যা হতে পারে। এই কথায় বিমানের ক্যানোপি খুলে রশিদ বেরিয়ে আসতেই তাঁকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে খানিক ধ্বস্তাধ্বস্তির পরে বিমানের পিছনের সিটে লাফিয়ে উঠে পড়েন মতিউর। অজ্ঞান হওয়ার আগের মুহূর্তে নিজের হাইজ্যাক হওয়ার কথা অস্ফুটে বলে মিনহাজ আর সেই কথা শুনতে পায় কন্ট্রোল রুম। ফলে তারা সঙ্গে সঙ্গে এই বিমানের হদিশ খুঁজতে ধাওয়া করে অন্য যুদ্ধবিমানের সাহায্যে। মতিউর ততক্ষণে বিমান উড়ান করিয়েছেন, অনেক নিচু দিয়ে বিমান চালাচ্ছিলেন তিনি যাতে রাডারে এই সঙ্কেত না ধরা পড়ে। একটা এফ-৮৬ বিমান ও একটি হেলিকপ্টার মতিউরের পিছু ধাওয়া করছিল। ভারতের সীমান্তে প্রবেশের খানিক আগে মিনহাজের জ্ঞান ফিরলে আবার ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু হয় এবং সবশেষে সিন্ধুর জিন্দা গ্রামের বালুময় ভূমিতে আছড়ে পড়ে তাদের বিমান। মতিউর রহমান প্যারাশ্যুট নিয়ে ওঠেননি বিমানে, ফলে তিনি শহীদ হন। বিমান ভেঙে পড়ার স্থান থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে মতিউর রহমানের মৃতদেহ পাওয়া যায়। ভারত সীমান্তের এত কাছে এসেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি মতিউর। নিজের দেশের মাটিকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে তাঁর এই দুঃসাহসিক আত্মত্যাগ সত্যই অবিস্মরণীয়।

পাকিস্তানের মাটিতে তাঁর মৃতদেহ কবরে সমাধিস্থ করা হয় এবং বহুদিন পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার সেই কবরের উপর লিখে রেখেছিল বিশ্বাসঘাতকের কবর। আর অন্যদিকে রশিদ মিনহাজের কবরের উপরে লেখা ছিল বীরের কবর। রশিদ মিনহাজকে জাতীয় বীর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সম্মান নিশান-ই-হায়দারে ভূষিত হন তিনি। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার সেই কবর দেশের মাটিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে এবং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান মরণোত্তর ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় মতিউর রহমানকে।

১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট বিমান দুর্ঘটনায় মতিউর রহমানের মৃত্যু হয়।

আপনার মতামত জানান