ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তীর মৃত্যু

কর্ণের মৃত্যু

মহাভারতের কর্ণপর্বের একেবারে শেষ ঘটনা হল কর্ণের মৃত্যু। দ্যূতসভায় দ্রৌপদীকে বিবস্ত্র করার প্রস্তাব কর্ণই দিয়েছিলেন। এ কারণে অর্জুন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ধর্মযুদ্ধে তিনি কর্ণকে বধ করবেন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পনেরোতম দিনে দ্রোণাচার্যের মৃত্যু হওয়ায় কৌরবপক্ষের সেনাপতি হন কর্ণ। তাঁর ভালো সারথি না থাকায় দুর্যোধন মদ্ররাজ শল্যকে অনুরোধ করেন কর্ণের সারথি হওয়ার জন্য। এ কথা শুনে শল্য শর্ত দেন, যুদ্ধ চলাকালীন তাঁর যা ইচ্ছা হবে তাই তিনি কর্ণকে বলবেন, তাঁর কথার কোনো প্রতিবাদ কর্ণ করতে পারবেন না। এই শর্তে যদি কর্ণ রাজি থাকেন তবেই মদ্ররাজ কর্ণের সারথি হবেন। এই প্রস্তাবে কর্ণ রাজি হয়ে শল্যকে রথে তুলে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন। কিন্তু শল্য কৃষ্ণ ও অর্জুনের ক্ষমতার উল্লেখ করে বারবার কর্ণকে ব্যঙ্গ করতে লাগলেন। কারণ যুদ্ধের আগে তিনি যুধিষ্ঠিরকে কথা দিয়েছিলেন যে, যেভাবেই হোক যুদ্ধের সময় তিনি কর্ণের মনোবল ভেঙে দেবেন। এই প্রতিজ্ঞা রাখার জন্য শল্য বারবার কর্ণকে ভয় দেখাতে ও উপহাস করতে লাগলেন।

এই ঘটনায় কর্ণ কিছুটা বিচলিত হলেন। তবুও তারপরের দুই দিন তিনি সমস্ত শক্তি দিয়ে যুদ্ধ করলেন। পান্ডবপক্ষের অসংখ্য সৈন্য তাঁর হাতে মারা গেল। বড় যোদ্ধাদের অনেকেই তাঁর কাছে হেরে গেলেন। সতেরো দিনের প্রথমে ভীমের হাতে দুঃশাসনের মৃত্যু হয়। তা দেখে দুর্যোধনের দশ ভাই একসঙ্গে এসে ভীমকে আক্রমণ করলে ভীম ভল্লের আঘাতে তাদের বধ করেন। তখন কর্ণের ছেলে বৃষসেন পান্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এলে অভিমন্যুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অর্জুন তাঁকে হত্যা করেন।

ছেলের মৃত্যু হওয়ার রাগে পাগল হয়ে গিয়ে কর্ণ অর্জুনকে আক্রমণ করলেন। প্রাচীনযুগে যেমন দেবরাজ ইন্দ্র ও বৃত্রাসুরের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল, ঠিক সেরকমই বিশ্বের দুই শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধারীকে যুদ্ধ করতে দেখে পৃথিবীর সমস্ত জীব দুই ভাগে ভাগ হয়ে দুই বীরের পক্ষ নিল। নক্ষত্র, আকাশ, পৃথিবী, নদী সমুদ্র পর্বত গাছপালা, উপনিষদ উপবেদ মন্ত্র ইতিহাস সমেত চারটি বেদ, বাসুকি প্রভৃতি নাগেরা, মাঙ্গলিক পশুপাখি, সূর্যদেব ছাড়া সব দেবতাদের সঙ্গে দেবর্ষি, ব্রহ্মর্ষি ও রাজর্ষিরা অর্জুনের পক্ষ নিলেন। অসুর রাক্ষস প্রেত পিশাচ ইত্যাদি অশুভ শক্তি, বৈশ্য শূদ্র সূত ও সঙ্কর জাতি, শিয়াল কুকুর প্রভৃতি পশু এবং দেবতাদের মধ্যে সূর্যদেব কর্ণের পক্ষ নিলেন।

কর্ণ ও অর্জুন একে অপরের দিকে নানারকম ভয়ানক মহাস্ত্র ছুঁড়তে লাগলেন। দুই পক্ষেরই হাতি ঘোড়া রথ ও পদাতিক সৈন্য ধ্বংস হতে লাগল। তাঁরা আগ্নেয়, বরুণ, বায়ব্য প্রভৃতি নানা অস্ত্র প্রয়োগ করতে লাগলেন। কিন্তু কর্ণের তেজে অর্জুন ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। অর্জুনের ঐন্দ্রাস্ত্র কর্ণের ভার্গবাস্ত্রে কাটা গেল দেখে ভীম রেগে গিয়ে অর্জুনকে বললেন, “অর্জুন! তুমি মন দিয়ে যুদ্ধ করো। তুমি যদি না পারো তবে আমাকে সুযোগ দাও, আমি এই গদা দিয়ে কর্ণকে হত্যা করব।” কৃষ্ণও অর্জুনকে বললেন, “তুমি কি মোহগ্রস্ত হয়ে আছ, তাই কৌরবদের আনন্দের চিৎকার শুনতে পাচ্ছ না? তোমার সব অস্ত্র কর্ণ কেটে ফেলছে কী করে? যে বীরত্ব দেখিয়ে তুমি রাক্ষস ও অসুরদের বধ করেছিলে সেইভাবেই তুমি আজ কর্ণকেও বধ করো। নয়তো আমার সুদর্শন চক্রই কর্ণের জীবন কেড়ে নেবে।” তখন অর্জুন ব্রহ্মাস্ত্র মারলে কর্ণ তাও কেটে দিলেন। তাই দেখে অর্জুন কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে আর একটি দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করলেন। এই ভয়ানক অস্ত্রের আঘাতে বহু যোদ্ধার মৃত্যু হল। এই সময় যুধিষ্ঠির সোনার কবচ পরে কর্ণ ও অর্জুনের যুদ্ধ দেখতে রণক্ষেত্রে এলেন।

হঠাৎ অর্জুনের ধনুকের গুণ ছিঁড়ে গেল। সেই ফাঁকে কর্ণ অসংখ্য ক্ষুদ্রক ও নারাচ বাণ দিয়ে কৃষ্ণ ও অর্জুনকে ক্ষতবিক্ষত করলেন। কিন্তু অর্জুন মুহূর্তের মধ্যেই ধনুকে নতুন গুণ চড়িয়ে বাণে বাণে আকাশ অন্ধকার করে ফেললেন এবং কর্ণের চক্ররক্ষক পাদরক্ষক অগ্ররক্ষক ও পৃষ্ঠরক্ষক যোদ্ধাদের ধ্বংস করে দিলেন। অবশিষ্ট যোদ্ধারা তখন কর্ণকে ফেলে পালাতে লাগলেন, দুর্যোধনের অনুরোধেও তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে রইলেন না। খান্ডবদাহনের সময় অর্জুন যার মাকে হত্যা করেছিলেন, তক্ষক নাগের ছেলে সেই অশ্বসেন এতদিন পাতালে লুকিয়েছিল। কর্ণ ও অর্জুনের যুদ্ধের খবর পেয়ে সে মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পাতাল থেকে উঠে এসে অর্জুনকে মারার উদ্দেশ্যে এক ভয়ঙ্কর বাণের রূপ ধরে কর্ণের তূণে প্রবেশ করল। এই ঘটনা দেখে ইন্দ্র ও লোকপালেরা হাহাকার করে উঠলেন। কর্ণ অশ্বসেনকে না দেখেই সেই বাণ অর্জুনের দিকে ছুঁড়লেন। তখন কৃষ্ণ তাঁর পায়ের চাপে অর্জুনের রথকে মাটিতে এক হাত বসিয়ে দিলেন, রথের ঘোড়াগুলি হাঁটু ভাঁজ করে রইল। ফলে কর্ণের বাণ লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। বাণের আঘাতে ইন্দ্রের কাছ থেকে পাওয়া অর্জুনের আশ্চর্য সোনার মুকুটটি নষ্ট হয়ে গেল, এ ছাড়া অর্জুনের আর কোনো ক্ষতি হল না। অর্জুন তখন মাথায় সাদা পাগড়ি বেঁধে নিলেন। মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে না পেরে অশ্বসেন আবার ওই অস্ত্র প্রয়োগ করার জন্য কর্ণকে অনুরোধ করল। কিন্তু কর্ণ এক অস্ত্র দুবার প্রয়োগ করতে রাজি হলেন না। অশ্বসেন তখন নিজেই অর্জুনকে আক্রমণ করতে গেল। কিন্তু অর্জুন দেখতে দেখতে তাকে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। ততক্ষণে কৃষ্ণ অর্জুনের রথকে মাটি থেকে তুলে ফেলেছেন। অর্জুন বাণের আঘাতে কর্ণের মুকুট, কুন্ডল ও উজ্জ্বল কবচ কেটে দিলেন এবং কবচহীন কর্ণকে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগলেন। অর্জুনের দারুণ আঘাত সহ্য করতে না পেরে কর্ণ অজ্ঞান হয়ে গেলেন। তখন অর্জুনের দয়া হল, তিনি আর বাণ মারতে চাইলেন না। কিন্তু শত্রুকে দয়া দেখানোর জন্য কৃষ্ণ অর্জুনকে তিরস্কার করলেন।

কিছুক্ষণ পর কর্ণের জ্ঞান ফিরে এল। আবার দুজনের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হল। সেই সময় হঠাৎ কর্ণের রথের চাকা মাটিতে বসে গেল। কর্ণের তখন মনে পড়ল, একবার তিনি এক ব্রাহ্মণের বাছুর মেরে ফেলেছিলেন। তখন ব্রাহ্মণ তাঁকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, মৃত্যুকালে তাঁর রথের চাকা মাটিতে বসে যাবে। আর ব্রাহ্মণ বলে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে অস্ত্রশিক্ষা করার জন্য গুরু পরশুরাম তাঁকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, মৃত্যুর সময় এলে সব দিব্যাস্ত্রের সঙ্কেত তিনি ভুলে যাবেন। কর্ণ বুঝতে পারলেন যে তাঁর মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। তিনি কোনো অস্ত্রের সঙ্কেত মনে না করতে পেরে হাতজোড় করে অর্জুনকে অনুরোধ করলেন, “অর্জুন! তুমি তো খুব ধার্মিক। দয়া করে একটু অপেক্ষা করো, আমার রথের চাকাটিকে তোলার মতো সময় দাও।” একথা শুনে কৃষ্ণ বললেন, “সূতপুত্র! বড় ভাগ্য যে তোমার ধর্মের কথা মনে পড়েছে। কিন্তু যখন পান্ডবদের পুড়িয়ে মারার পরামর্শ দিয়েছিলে, দ্রৌপদীকে সভায় এনে অপমান করেছিলে, ছল করে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের সম্পত্তি কেড়ে নিয়েছিলে—তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? এখন আর ধর্ম ধর্ম বলে চিৎকার করে কোনো লাভ হবে না।”

এইবার কর্ণের চোখে জল এল। তিনি কোনো কথা না বলে আবার যুদ্ধ করতে শুরু করলেন। একটি ভীষণ বাণে অর্জুনকে অজ্ঞান করে তিনি ব্যস্ত হয়ে চাকা উঠানোর জন্য রথ থেকে নামলেন। কিন্তু অনেক টানাটানি করেও তিনি রথের চাকা তুলতে পারলেন না।
ওদিকে অর্জুনের জ্ঞান ফিরে এল। কৃষ্ণ তখন তাঁকে বললেন, “অর্জুন! সময় এসে গেছে। পূরণ করো তোমার প্রতিজ্ঞা, প্রতিশোধ নাও পাঞ্চালীর অপমানের। রথে উঠতে দিও না একে। অর্জুন! হত্যা করো অঙ্গরাজ কর্ণকে।” কৃষ্ণের কথা শুনে অর্জুন গান্ডীবে ‘অঞ্জলীক’ নামে এক ভয়ঙ্কর অস্ত্র জুড়লেন। তার তেজে পৃথিবী কেঁপে উঠল, আকাশে মেঘের গর্জনের ভীষণ শব্দ শোনা যেতে লাগল। দেখতে দেখতে সেই মহাস্ত্র ঘোর গর্জনে প্রচণ্ড তেজে ছুটে গিয়ে কর্ণের মাথা কেটে ফেলল। সবাই অবাক হয়ে দেখলেন কর্ণের দেহ থেকে এক অপরূপ জ্যোতি বেরিয়ে এসে সূর্যের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।

কর্ণের মৃত্যু দেখে পান্ডবপক্ষের যোদ্ধারা আনন্দে সিংহনাদ করতে লাগলেন। আর কৌরবরা আতঙ্কে অস্থির হয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে লাগলেন। সন্ধ্যা হয়ে এল, দুর্যোধন শোকে পাগলের মত হয়ে গিয়ে কর্ণের নাম ধরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে শিবিরে ফিরে গেলেন।

তথ্যসূত্র


  1.  ‘মহাভারত’, কালীপ্রসন্ন সিংহ, কর্ণপর্ব, অধ্যায় ৯০-৯২, পৃষ্ঠা ১৮১-১৯৫
  2. ‘ছেলেদের মহাভারত', উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, বসাক বুক স্টোর প্রাইভেট লিমিটেড, তৃতীয় মুদ্রণ, কর্ণপর্ব, পৃষ্ঠা ১৭৪-১৭৮
  3. ‘মহাভারত সারানুবাদ', রাজশেখর বসু, কলিকাতা প্রেস, তৃতীয় প্রকাশ, কর্ণপর্ব, অধ্যায় ২০, পৃষ্ঠা ৪৫৩-৪৫৮

আপনার মতামত জানান