বনবিবি

বনবিবি

সুন্দরবনের জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। দুয়েতেই প্রাণ যাবে- বাঘে খাবে নাকি কুমিরে খাবে এই ভয়ে মানুষের মনে বাসা বাঁধেন নানা দেব-দেবী। কখনো বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়, আবার কখনো বাঘের হাত থেকে ত্রাণকর্তা বনবিবি সুন্দরবনের মউলি, কাঠুরেদের রক্ষা করেন। লোকবিশ্বাসে, লোকপুরাণে এদের নিয়েই কথা-কাহিনি রয়েছে অনন্ত। বনবিবি (BONBIBI) আর দক্ষিণ রায় একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। চুক্তি করে তারা ভাগ করে নিয়েছে জঙ্গলের সীমানা। সুন্দরবনের মানুষদের রক্ষার ভার সেই বনবিবির, আর ভুল করেও কেউ সীমানা পেরিয়ে দক্ষিণ রায়ের জমিতে পা রাখলে তার ভবলীলা সাঙ্গ করতে ছুটে আসবে বাঘমামাদের দল। শিহরণ জাগানো এই রকম রোমাঞ্চকর কাহিনি জড়িয়ে আছে বনবিবিকে ঘিরে। চলুন জেনে নিই, দক্ষিণবঙ্গের এই লোকদেবী সম্পর্কে।

বাঘের দেবতা যেমন দক্ষিণ রায়, তেমনই বাঘের দেবী হলেন বনবিবি। বনবিবিই সুন্দরবনের মানুষকে নিরাপদ আশ্রয় দেন, জঙ্গলের রক্ষাকারী শক্তি তিনিই। বকখালির দিকে গেলে এখনও কেউ কেউ দেখতে পারেন বনবিবির মন্দির। মূর্তির গায়ে শাড়ি জড়ানো কোথাও, কোথাও আবার পাজামা বা ঘাগরা। বনবিবির মূর্তির পাশে মাঝে মাঝে আরেকজন মুগুরধারী পুরুষকে দেখা যায়। ব্যাঘ্রবাহনা এই দেবীই জঙ্গলবাসীদের কাছে বরাভয়দাত্রী। তিনিই বনবিবি। হিন্সু-মুসলমান উভয়েই তাঁকে সমানভাবে মানে, হিন্দুরা বলে বিবিমা আর মুসলমানরা বলে বনবিবি। দক্ষিণবঙ্গের লৌকিক দেবীদের মধ্যে এরকম অনেক ‘বিবি’ নাম পাওয়া যায়, যেমন – ওলাবিবি, সাতবিবি, দরবারবিবি, আর পাওয়া যায় কালু গাজী, দেওয়ানগাজী, বড়খাঁগাজী প্রভৃতিদের নামও। গবেষকরা অনুমান করেছেন যে, একসময় ইসলাম ধর্মপ্রচারের জন্য বহু মুসলিম আরব থেকে এদেশে এসে নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল, তাদের মধ্যেকার নারী ও পুরুষরা পরস্পরকে ভাই-বোন বলেও সম্বোধন করতেন। ফলে ঐ গাজী নামের সকলে একে অপরের ভাই এবং মুসলিম মহিলাদের বলা হতো বোন। এই বোন থেকেই হয়তো বনবিবি কথার জন্ম বলে অনেকের অনুমান। ঐ যে বনবিবির মূর্তির পাশে এক পুরুষ মূর্তি সে আসলে তাঁর ভাই – শাহজঙ্গুলী। শাহজঙ্গুলী হলেন জঙ্গলের বাদ্‌শাহ। এছাড়া এই বনবিবির কোলে থাকে দুখে নামের একটি শিশু। তবে হিন্দুদের দেবীমূর্তি আর মুসলিমদের দেবীমূর্তির মধ্যে পার্থক্য আছে। মুসলিমদের কাছে বনবিবির মাথায় বুনো লতা-পাঁতা আঁকা থাকে, আর থাকে টুপি, মাথায় বিনুনি, টিকলি, গলায় নানারকম হার, পরনে পাজামা বা ঘাগরা আর পায়ে থাকে জুতো-মোজা। কিন্তু হিন্দুদের বনবিবি দেবীর গায়ের রঙ হলুদ, মাথায় থাকে মুকুট, গলায় হার। সবক্ষেত্রে বনবিবির বাহন থাকে না।

এই বনবিবিকে নিয়েই লেখা হয়েছে ‘বনবিবি জহুরানামা’ পালা, ছড়িয়ে আছে কত লোকশ্রুতি। শোনা যায়, আরবের এক ফকিরের পরিবারে জন্ম হয় বনবিবির। তাঁর বাবার নাম ইব্রাহীম, ইব্রাহীমের দুই স্ত্রী – ফুলবিবি আর গুলানবিবি। ফুলবিবির সন্তানাদি না হওয়ায় তিনি গুলানবিবিকে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। ফুলবিবি ইব্রাহীমের কাছে নিজের মনোবাসনা পূরণের দাবি নিয়ে গুলানবিবিকে বনে পাঠাতে চায়। পুর্বপ্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ইব্রাহীম তাই করতে বাধ্য হন। জঙ্গলে নির্বাসনে থাকাকালীন বনবিবি আর শাহজঙ্গুলীর জন্ম হয় এবং পরে ইব্রাহীম সুন্দরবন থেকে তাঁদের মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু বনবিবি বা শাহজঙ্গুলী কেউই ফিরতে চায় না এই জঙ্গলের মায়া ছেড়ে। ‘বনবিবির জহুরানামা’ পালায় রয়েছে শাহজঙ্গুলীর সঙ্গে দক্ষিণ রায়ের যুদ্ধের কথা বলা আছে। বনবিবির সঙ্গে জঙ্গলের অধিকার নিয়ে নারায়ণীর সঙ্গেও যুদ্ধ হয়। দক্ষিণ রায় কিংবা নারায়ণী কেউই বনবিবিদের পরাজিত করতে পারেনি। ফলে চুক্তির ভিত্তিতে নারায়ণীকে সুন্দরবনের একাংশ ছেড়ে দেন বনবিবি আর দক্ষিণ রায়ের সঙ্গে সীমানা ভাগাভাগি হয় বনবিবির। জঙ্গলের গভীরে রাজ করবেন দক্ষিণ রায় আর মানুষ যেখানে বাস করে সেখানে তাদের রক্ষা করবেন বনবিবি স্বয়ং। এই গল্পের পাশাপাশি বণিক ধনাই আর মোনাইয়ের কাহিনিও অনেকের মুখে শোনা যায়। এই ধোনাই-মোনাইয়ের সঙ্গে দক্ষিণ রায়ের যুদ্ধ এবং বনবিবির সঙ্গে সংঘাতের পরে বনবিবি তাঁর পুত্র দুখের সঙ্গে ধনামৌলের মেয়ে চম্পার বিবাহ দেন। মরহুম মুনশী মহম্মদ খাতের-এর লেখা ‘বনবিবি জহুরানামা’য় এই সমস্ত কাহিনি রয়েছে যেগুলি গ্রামবাংলায় পালাগান হিসেবে খুবই জনপ্রিয়।

জঙ্গলে বা পল্লীতে দুই জায়গাতেই বনবিবির পুজো হয়ে থাকে। সুন্দরবনের মানুষদের কাছে এই বনবিবির পুজো খুবই জাগ্রত এবং এজন্য তারা অনেক নিয়ম-কানুন মানেন। জঙ্গলের যাওয়ার আগে এক সপ্তাহ তাঁরা খুব শুদ্ধভাবে থাকেন, স্ত্রী-সংসর্গ করেন না, স্নানের পর ময়লা কাপড় বা বাসি কাপড় পরেন না। তারপর জঙ্গলে যাওয়ার দিন বাড়িতে ভক্তিভরে বনবিবির পুজো করেন তারা। আর অনেকে আবার জঙ্গলে গিয়ে কতগুলি মুরগি ছেড়ে দেয়। যতদিন বাড়ির লোকেরা জঙ্গলে থাকেন, ততদিন পর্যন্ত নারীরা আমিষ খান না, সিঁদূর পরেন না, এমনকি বাড়িতে রোজই বনবিবির পুজো করেন। পরে তারা ফিরে এলে সাড়ম্বরে বনবিবি দেবীর পূজা করা হয়। প্রতিবছর পয়লা মাঘ তারিখে এই বনবিবির পুজো করে থাকেন সুন্দরবনের মানুষেরা। তাঁদের বিশ্বাসে এই দেবী আজও বাঘের হাত থেকে রক্ষা করেন মানুষকে। জঙ্গলের রক্ষাকর্তা দেবী ব্যাঘ্রবাহনা বনবিবি।

তথ্যসূত্র


  1. ড. দেবব্রত নস্কর, ‘চব্বিশ পরগণার লৌকিক দেবদেবী : পালাগান ও লোকসংস্কৃতি জিজ্ঞাসা’, দে’জ পাবলিশিং, ১৯৯৯, পৃ ৩৯৭-৪০৫
  2. https://www.prothomalo.com/
  3. https://www.anandabazar.com/
  4. https://roar.media/

One comment

আপনার মতামত জানান