মহাভারত

ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুরের জন্ম

ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু বা বিদুর ছিলেন শান্তনু এবং সত্যবতীর নাতি। কিন্তু শান্তনু এবং সত্যবতীর পুত্রেরা তাদের পিতা ছিলেন না। ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুরের জন্ম হয়েছিল নিয়োগপ্রথার মাধ্যমে।  তার বৃত্তান্ত জানাব এখানে।

শান্তনুর দুই পুত্রেরই মৃত্যুতে বংশের কেউ সিংহাসনে বসার বা শান্তনুকে পিণ্ডদান করার জন্য রইল না। রাজমাতা সত্যবতী বুঝতে পারল ভীষ্মের ভীষণ প্রতিজ্ঞায় কি ভীষণ ক্ষতি হয়ে গেছে রাজপরিবারের। একদিন ভীষ্মকে ডেকে সে বলল, “আমার দুই সন্তান তো মারা গেল  অকালবয়সেই। এখন বংশরক্ষা করবে কে? নিয়োগপ্রথার নিয়ম মেনে তুমিই এখন তোমার ভাইয়ের বউদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করো।”
তখনকার সময়ে রাজার অকালমৃত্যুতে বা অন্য কারনে রাজার কোনও পুত্রসন্তান না থাকলে রাজার কোনও ভাই বা ব্রাহ্মণের ঔরসে রানীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করার নিয়ম ছিল। নিয়োগপ্রথার এই নিয়ম মেনে সত্যবতীই ভীষ্মকে অনুরোধ করেছিল।
কিন্তু রাজি হল না ভীষ্ম, “তাহলে তো আমার প্রতিজ্ঞাই মিথ্যে হয়ে যায়। তার থেকে বরং নিয়োগপ্রথার নিয়ম মেনেই আপনি কোনও ব্রাহ্মণকে এই অনুরোধ করুন।”

তখন সত্যবতী তাকে নিজের কথা বলল। বলল তার কানীন পুত্র ব্যাসদেবের জন্মের কথা। ভীষ্ম শুনেই বলল, “এ তো দারুণ প্রস্তাব। আপনি অবশ্যই তাকে ডেকে পাঠান।”
সত্যবতীর ডাকে ব্যাসদেব এল। এসে জানতে পারল তার মায়ের অনুরোধ। তারপর বলল, “কিন্তু মা! তার জন্য যে একবছর অপেক্ষা করতে হবে রানীদের।”
“কিন্তু এত সময় যে নেই আমাদের হাতে। সিংহাসনে রাজা নেই। এভাবে তো চলতে পারে না।”, সত্যবতী বলল।
“তাহলে আমার বিকট রূপ কিন্তু রানীদের সহ্য করতে হবে।”
সত্যবতী রাজি হল তাতেই। অম্বিকাকে ডেকে বলল, “আমাদের ভরতবংশ পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব এখন তোমার। সেই অনুযায়ী তোমাকে নিয়োগপ্রথার নিয়ম মেনে তোমার দেবরের সাথে মিলিত হতে হবে। আজই সে রাত্রিরে আসবে তোমার কাছে।”

অম্বিকা সেই রাতে রাজপালঙ্কে শুয়ে মনে মনে তার দেবর ভীষ্মকে চিন্তা করতে থাকল। ভীষ্মের বীরত্ব, পৌরুষ এইসব চিন্তা করতে করতে মুখে তার ফুটে উঠল হাসি। কিন্তু সেই হাসি উবে গেল তখন, যখন তার ঘরে প্রবেশ করল ব্যাসদেব। ব্যাসবেদের জটা, দাঁড়ি আর গায়ের বিকট গন্ধে ভয়ে অম্বিকা চোখ বুজিয়ে নিল। ব্যাসদেব সেই অবস্থাতেই এল তার কাছে। মায়ের আদেশে মিলিত হল অম্বিকার সাথে। কিন্তু সারাটা সময় একবারের জন্যও চোখ খুলল না অম্বিকা। মিলন সম্পূর্ণ করে যখন ব্যাসদেব বেরিয়ে এল অম্বিকার ঘর থেকে, তখন সত্যবতী জিজ্ঞেস করল তাকে, “অম্বিকার গর্ভে গুণবান রাজপুত্র হবে তো?”
“মা! এই পুত্র প্রচণ্ড বলবান, উৎসাহী হবে। এর একশত পুত্রও হবে। কিন্তু অম্বিকা সারাক্ষণ চোখ বুজে থাকার জন্য এই পুত্র জন্মান্ধ হবে।” এই পুত্রটি হল ধৃতরাষ্ট্র।

কিন্তু অন্ধ পুত্র রাজ্যের রাজা হতে পারবে না। তাই এবার ডাক পড়ল অম্বালিকার। অম্বিকার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা বলে সত্যবতী তাকে ব্যাসদেবের জন্য রাতে প্রস্তুত থাকতে বলল, “কুরুবংশের আগামী রাজার জন্ম দিতে হবে তোমায়। এ দায়িত্ব গ্রহণ কর। আমার ছেলে ব্যাসের জন্য আজ রাতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থেকো।”

মানসিক প্রস্তুতি তো নিল অম্বালিকা। কিন্তু নিজের ইচ্ছায় কিছু করা আর কারও আদেশে করা এক ব্যাপার না, তাও আবার এই ব্যাপারে। ব্যাস এল, অম্বিকা দেখল তার রূপ, ভয়েতে গুটিয়ে গেল সে। তাই তার পুত্র পাণ্ডুবর্ণ হয়ে জন্মায়, তার নামও হল পাণ্ডু।

সত্যবতী ব্যাসদেবকে আরও একটি পুত্রের অনুরোধ করল। অম্বিকাকে ডেকে আবার বলল ব্যাসদেবের জন্য প্রস্তুত থাকতে। কিন্তু আগের অভিজ্ঞতা থেকে অম্বিকা ব্যাসের কাছে যেতে রাজি হল না। ব্যাসের কাছে পাঠাল একটা দাসীকে।ব্যাসদেবের ঔরসে সেই দাসীর গর্ভে জন্ম নেয় বিদূর।

তথ্যসূত্র


  1. মহাভারত সারানুবাদ - রাজশেখর বসু
  2. মহাভারতের একশোটি দুর্লভ মুহূর্ত - ধীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য

 

10 comments

    1. সেই নিয়েই বছরের পর বছর গবেষণা চলছে এবং এখনো সকলের মধ্যে তার আবেদন একটুকু কমেনি। মহাভারতের মতো কালজয়ী সৃষ্টি খুব কমই আছে।

  1. “রাজার অকাল মৃত্যুতে বা অন্য কারণে কোনও পুত্রসন্তান না থাকলে রাজার কোন ভাই বা ব্রাহ্মণেরৈ ঔরসে রানীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করার প্রথা ছিল।” তার স্বপক্ষে কি দলিল আছে? থাকলে কোন গ্রন্থে আছে? পাঠকদের জানাবেন।

  2. ভুল আছে। ব্যাসদেবকে দেখে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে যায় অম্বালিকা, অম্বিকা নয়।

আপনার মতামত জানান