বিভা চৌধুরী

বিভা চৌধুরী

ব্রিটিশ শাসিত ভারতে প্রথম প্রজন্মের মহিলা পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে এক অগ্রগণ্য নাম বিভা চৌধুরী (Bibha Chowdhuri)। আজ থেকে প্রায় একশো বছরেরও বেশি সময় আগে, ভারতের বুকে পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করা এবং উচ্চতর গবেষণার জন্য ইংল্যাণ্ড ভ্রমণ এবং সেখান থেকে ফিরে এসে ভারতের বুকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমেই তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। কিন্তু আজীবনই অবহেলা আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মধ্য দিয়েই জীবন অতিবাহিত হয়েছে তাঁর। পুরুষশাসিত সমাজে একজন নারী গবেষক হিসেবে বিদ্যায়তনিক পরিমণ্ডলে কখনও সেভাবে চর্চিত হননি বিভা চৌধুরী। বিজ্ঞানী সি এফ পাওয়েলের অনেক আগেই কলকাতার বসু বিজ্ঞান মন্দিরে প্রথম ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করে বিভা চৌধুরী মেসন কণার ভর নির্ণয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাছাড়া ‘টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’ সংস্থায় তিনিই ছিলেন প্রথম কর্মরত মহিলা গবেষক। ভারতীয় পদার্থবিদ বিভা চৌধুরীর গবেষণার পরিসর জুড়ে ছিল কণা পদার্থবিদ্যা এবং মহাজাগতিক রশ্মিসমূহ। মৃত্যুর ৩০ বছর পরে তাঁর স্মরণে ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন’ (IAU) সেক্সট্যান নক্ষত্রপুঞ্জের একটি নক্ষত্রকে তাঁর নামানুসারে ‘বিভা’ নামে নামাঙ্কিত করেছে। কিন্তু জীবদ্দশায় কখনও জাতীয় পুরস্কার কিংবা কোনও সামাজিক স্বীকৃতি বা সম্মান পাননি বিভা চৌধুরী।

১৯১৩ সালের ৩ জুলাই কলকাতায় বিভা চৌধুরীর জন্ম হয়। তাঁর বাবা বঙ্কু বিহারী চৌধুরী পেশায় একজন ডাক্তার ছিলেন এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল উর্মিলা দেবী। তাঁর মা ছিলেন জনৈক ব্রাহ্ম সমাজ সদস্যের কন্যা। উর্মিলা দেবী এবং বঙ্কু বিহারীর তৃতীয় জ্যেষ্ঠ সন্তান ছিলেন বিভা চৌধুরী। তাঁর আরও চার বোন ও এক ভাই ছিল। বিভার কাকিমা নির্মলা দেবীর সঙ্গে প্রখ্যাত চিকিৎসক নীলরতন সরকারের বিবাহ হয়েছিল। তাঁর বোন রমা চৌধুরী পরবর্তীকালে ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ে শিক্ষয়িত্রী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। বিভা চৌধুরীর মাতৃকুল ব্রাহ্ম সমাজের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিল।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা করেন বিভা চৌধুরী। ১৯৩৬ সালে ঐ কলেজ থেকেই একমাত্র মহিলা পড়ুয়া হিসেবে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। তাঁদের ১৯৩৪-৩৬ সালের ব্যাচের ২৪ জন পড়ুয়ার মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র ছাত্রী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তর পাঠক্রম চালু হওয়ার পর স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ তৃতীয় মহিলা ছিলেন বিভা চৌধুরী।

১৯৩৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পরে বিভা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের তৎকালীন পালিত অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসু ওরফে ডি এম বসুকে অনুরোধ করেন তাঁর গবেষক দলে যোগ দেওয়ার জন্য। কিন্তু অধ্যাপক ডি এম বসু মহিলাদের জন্য উপযুক্ত কোনও গবেষণা প্রকল্পের সঙ্গে তিনি যে জড়িত নন, সে কথা স্পষ্টভাবে জানান। এই দেবেন্দ্রমোহন বসু ছিলেন তাঁর মায়ের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়। মহিলারা যে পদার্থবিদ্যার জটিল ও কঠিনতর গবেষণায় অংশগ্রহণ করতে পারে, সে কথা কল্পনাতেও ছিল না তাঁর। তাই প্রথমে বিভার অনুরোধে খুব একটা আমল দেননি তিনি। দেবেন্দ্রমোহন বসু যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলকাতার বসু বিজ্ঞান মন্দিরে গবেষণা করতে আসেন, সেই সময়েই বিভা চৌধুরীও বসু বিজ্ঞান মন্দিরে যোগ দেন একজন তরুণী গবেষক হিসেবে। বসু বিজ্ঞান মন্দিরে কাজ করার সময় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন বিভা চৌধুরী। তাঁর সমস্ত গবেষণাই কেন্দ্রীভূত ছিল মহাজাগতিক রশ্মির উপর যা কিনা সেই সময় পরা-পারমাণবিক কণার একমাত্র উৎস ছিল। বিভা চৌধুরীর প্রথম গবেষণাপত্রটির নাম ছিল – ‘স্টাডিজ ইন নিউক্লিয়ার ডিসইন্টিগ্রেশন বাই দ্য ফটোগ্রাফিক প্লেট মেথড-ওয়ান, ডিসইন্টিগ্রেশন অফ সামারিয়াম নিউক্লিয়াস বা কসমিক রে’স’ (Studies in nuclear disintegration by the photographic plate method-I, Disintegration of samarium nucleus by cosmic rays)। ডি এম বসু এবং বিভা চৌধুরী উভয়েই এই গবেষণার জন্য ১৯৩৮ সালে সান্দাকফু পর্বতশৃঙ্গে প্রায় ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় বহু মাস ধরে মহাজাগতিক রশ্মির সামনে উন্মুক্ত ফটোগ্রাফিক প্লেট ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। সেই সময় কণা ত্বরিতকারী (Particle Accelerator) ছাড়াই উচ্চতর পর্বতশৃঙ্গে গিয়ে এইভাবেই পরা-পারমাণবিক কণাগুলির পরীক্ষা করা হত এবং ক্লাউড চেম্বার তথা মেঘকক্ষের সাহায্য নেওয়া হত। কিন্তু বিভা চৌধুরী এবং দেবেন্দ্রমোহন বসু এক্ষেত্রে তাঁদের পরীক্ষায় কোনওরকম মেঘকক্ষের সাহায্য নেননি। একটি বদ্ধ সরঞ্জামের মধ্যে ইথানল বা অন্য পদার্থের বাষ্পপূর্ণ অবস্থাকে মেঘকক্ষ বলা হয় যার মধ্য দিয়ে কোনও উচ্চশক্তি সম্পন্ন কণা চলে গেলে জেট বিমানের মত একটা রেখাপথ এঁকে যায়। সেই রেখাপথ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগেই তার থেকে কণাটির ভর, আধান কিংবা ভরবেগ সংক্রান্ত নানা তথ্য জানা যায়। মেঘকক্ষের পরিবর্তে প্রথম বিভা চৌধুরী ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করেন যেখানে কণার গতিপথ সহজে নির্ণয় করা সম্ভব হত এবং তা খুব দ্রুত অদৃশ্য হওয়ার সমস্যাও ছিল না। এর মধ্য দিয়ে বিভা এবং দেবেন্দ্রমোহন বসু মেসোট্রন এবং মেসন কণার ভর, গতিবেগ, আধান ইত্যাদি নির্ণয় করতে সমর্থ হন যা ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকায় একই শিরোনামে ১৯৪১ ও ১৯৪২ সালে পরপর দুটি প্রবন্ধে প্রকাশিত হয়। দার্জিলিং, সান্দাকফু এবং ফারি জং পর্বতে এই ফটোগ্রাফিক প্লেটগুলিকে তিনটি আলাদা আলাদা উচ্চতায় রেখে যথাক্রমে পাই-মেসন ও মিউয়ন কণার অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন তাঁরা। যদিও হাফটোন প্লেট ব্যবহার করায় ঐ কণাগুলির ভর নির্ণয়ে সামান্য ত্রুটি ছিল। ঐ সময়ই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, ফলে ফুলটোন প্লেট সংগ্রহ করে দ্বিতীয়বার নিখুঁত পরীক্ষা করা তার পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। তাঁদের এই গবেষণার প্রায় সাত বছর পরে ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী ড. সিসিল পাওয়েল উন্নতমানের প্লেট ব্যবহার করে পাই মেসন ও মিউয়ন কণা আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। ফলে তাঁর বহু আগে এই গবেষণার প্রথম ধাপ করা হলেও বিভা চৌধুরী কোনও স্বীকৃতি পাননি। তবে পাওয়েলের নির্ণীত ভরের সঙ্গে বিভা চৌধুরী এবং ডি এম বসুর গবেষণালব্ধ ভরের অনেকটাই মিল ছিল।

এরপরে ১৯৪৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানচেস্টার শহরে চলে আসেন বিভা চৌধুরী। সেখানে মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে গবেষণারত স্যার প্যাট্রিক ব্ল্যাকেটের অধীনে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। বিস্তৃত বায়ু ঝরনা(extensive air shower) নিয়ে গবেষণাকর্মে বিভার গবেষণা-তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকায় ছিলেন স্যার প্যাট্রিক ব্ল্যাকেট। স্যার প্যাট্রিক একটি নতুন ধরনের মেঘকক্ষ আবিষ্কার করেছিলেন, যার মধ্যে একটি গিগার কাউন্টার ছিল যেটি কণার প্রতি অত্যন্ত বেশিমাত্রায় সংবেদনশীল। ১৯৫২ সালে ‘এক্সটেন্সিভ এয়ার শাওয়ারস উইথ পেনিট্রেটিং পার্টিকলস’ নামে একটি গবেষণাপত্র জমা দিয়ে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন বিভা চৌধুরী। ঐ বছরই ‘ম্যানচেস্টার হেরাল্ড’ নামে একটি স্থানীয় পত্রিকায় বিভা চৌধুরীর এই গবেষণা ও তাঁর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়।

ইতিমধ্যে ভারতে ফিরে ১৯৪৯ সালে ড. হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা সদ্য প্রতিষ্ঠিত ‘টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’-এ আহ্বান জানান বিভা চৌধুরীকে। এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রথম মহিলা ছিলেন বিভা চৌধুরী। এখানেও বিস্তৃত বায়ু ঝরনা বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যান তিনি। ১৯৫৪ সালে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে একজন অতিথি লেকচারার হিসেবে বক্তব্য রেখেছিলেন বিভা চৌধুরী। ১৯৫৭ সালে মোট আট বছর কাজ করার পরে টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ সংস্থা থেকে অবসর নেন তিনি। এরপরে কলকাতায় বেঙ্গল ইঞ্জিয়ারিং কলেজে গবেষণা করতে শুরু করেন বিভা। কিছুদিনের মধ্যেই আহমেদাবাদের ‘ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি’তে নিযুক্ত হন বিভা চৌধুরী। সেই সময় ডিরেক্টর বিক্রম সারাভাইয়ের তত্ত্বাবধানে বিখ্যাত কোলার গোল্ড ফিল্ডস পরীক্ষা চলছিল, এই কাজে বিভা চৌধুরীর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে তাঁর কাজের সমস্ত নথি এই প্রকল্প তথা সংস্থার কাছ থেকে লুপ্ত হয়ে যায়। বিক্রম সারাভাই মারা যাওয়ার পরে স্বেচ্ছা অবসর গ্রহণ করেন বিভা চৌধুরী। দীর্ঘ ১৪ বছর আহমেদাবাদের ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করলেও তার কোনও ইতিহাসই আজ আর অক্ষত নেই। সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এর ডিরেক্টর অধ্যাপক ডি এন কুণ্ডুর আহ্বানে ঐ সংস্থায় যোগ দেন বিভা চৌধুরী। এছাড়া ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স’ সংস্থাতেও সক্রিয় গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।

মৃত্যুর ৩০ বছর পরে তাঁর স্মরণে ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন’ (IAU) সেক্সট্যান নক্ষত্রপুঞ্জের একটি নক্ষত্রকে তাঁর নামানুসারে ‘বিভা’ নামে নামাঙ্কিত করেছে।

১৯৯১ সালের ২ জুন কলকাতায় বিভা চৌধুরীর মৃত্যু হয়।   

2 comments

আপনার মতামত জানান