অজয় হোম

অজয় হোম

স্বনামধন্য বাঙালি পক্ষীবিদ হিসেবে অজয় হোম (Ajoy Home) ‘বার্ডম্যান অফ বেঙ্গল’ নামেই পরিচিত। অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম, স্যামুয়েল টিক্‌ল কিংবা ভারতের সালিম আলির সঙ্গে এক গোত্রে উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। বাংলার বহু অজানা, অচেনা পাখিকে বাঙালির কাছে পরিচিত করে তুলেছেন তিনি। তাঁর দীর্ঘ পাখি বিষয়ক গবেষণার ফসল হিসেবে ‘বাংলা পাখি’ বইটি আজও পাখিপ্রেমীদের কাছে সমাদৃত হয়। এই বইটি এবং তাঁর লেখা ‘চেনা অচেনা পাখি’ এই দুটি বইয়ের জন্য ১৯৯৬ সালে তাঁকে মরণোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ইণ্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের প্রধান গ্রন্থাগারিক হিসেবেও কাজ করেছেন অজয় হোম । বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, সায়েন্স এডুকেশন অফ বেঙ্গল-এর পক্ষ থেকেও পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন অজয় হোম। শুধু পক্ষীচর্চাই নয়, ক্রিকেট, রান্না আর রবীন্দ্রসাহিত্য চর্চাতেও নিয়োজিত ছিলেন তিনি।

১৯১৩ সালে কলকাতায় এক ব্রাহ্ম পরিবারে অজয় হোমের জন্ম হয়। তাঁর বাবা ছিলেন বিখ্যাত ব্রাহ্ম সংস্কারক এবং সিটি স্কুলের শিক্ষক গগন চন্দ্র আর তাঁর মায়ের নাম ছিল বসন্তবালা দেবী। অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহেই তাঁদের আদি বাড়ি ছিল, পরে তাঁর বাবা-মা কলকাতায় এসে থাকতে শুরু করেন। গগন চন্দ্র  এবং বসন্তবালা দেবীর সাত সন্তানের মধ্যে ষষ্ঠ সন্তান ছিলেন অজয় হোমের বড় ভাই অমল চন্দ্র হোম যিনি পরবর্তীকালে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল গেজেটের সম্পাদক হন, তিনি সুকুমার রায়ের মানডে ক্লাবেরও সদস্য ছিলেন। তাঁর বাবা গগনচন্দ্র কৃষ্ণকুমার মিত্রের সম্পাদিত ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই পশু-পাখি, প্রকৃতি, গাছপালার প্রতি গভীরভাবে অনুরাগী ছিলেন। তাঁর দশ বছরের জন্মদিনে ড. সুন্দরীমোহন দাসের স্ত্রী হেমাঙ্গিনী দেবী তাঁকে একটি ময়না পাখি উপহার দিয়েছিলেন। মূলত সেই সময় থেকেই থেকেই পাখির প্রতি গভীরভাবে আসক্ত হয়ে পড়েন অজয় হোম । তাঁর মা বসন্তবালা দেবী নিজেও পাখি ভালোবাসতেন। পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সালে শিলং নিবাসী ডা. বিনোদ বিহারী এবং লীলাময়ী রায়ের কন্যা সুপর্ণা দেবীর সঙ্গে অজয় হোমের বিবাহ হয়। সুপর্ণা দেবী ছিলেন বিখ্যাত ব্রাহ্ম উপাসক সীতানাথ তত্ত্বভূষণের নাতনি। ১৯৮৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সুপর্ণাদেবী অসুস্থতার কারণে মারা যান।

ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ হয় অজয় হোমের। এরপরে স্নাতক স্তরে পড়ার জন্য তিনি কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হন।


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

স্কুলের পড়া শেষ করে অজয় হোম স্পোর্টিং ইউনিয়নে ক্রিকেট খেলার উদ্দেশ্যে বিখ্যাত ক্রিকেটার কার্তিক বসু এবং গণেশ বসুর কাছে ক্রিকেটের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। উইকেট-রক্ষক হিসেবে তাঁর বেশ খ্যাতি হয়েছিল সেই সময়। পরে বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ ড. প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের অনুরোধে অজয় হোম কলকাতায় ইণ্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের বিশাল গ্রন্থাগারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান গ্রন্থাগারিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন অজয় হোম। আপামর বাঙালি পাঠকের কাছে পাখি চেনা বা খোদ পক্ষীবিজ্ঞানের উপর ভালো মানের বইয়ের অভাব লক্ষ করেই পক্ষীবিজ্ঞানের উপর বই লিখতে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন তিনি। অবিভক্ত আসাম সহ পূর্ব ভারতের নানা প্রান্ত এবং সুন্দরবনে দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকেই অজয় হোম লিখেছিলেন তাঁর প্রথম বই ‘বাংলার পাখি’। তারপর একে একে তিনি লিখে ফেলেন ‘চেনা অচেনা পাখি’ নামে আরেকটি পক্ষীবিজ্ঞানের বই। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য ‘বাংলার পাখি’ বইটির প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক এবং আলঙ্কারিক সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ রায় এক সূত্রে তাঁর পারিবারিক বন্ধুও ছিলেন। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত এই বই প্রথম প্রকাশ হওয়া মাত্রই সমগ্র বাংলায় সাড়া ফেলে দেয়। তাঁর আগে আরেক বিখ্যাত বাঙালি পক্ষীবিদ সত্যচরণ লাহার থেকেও অজয় হোমের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। সত্যচরণ পক্ষীবিজ্ঞানের উপর খুব বেশি বাংলা বই লেখেননি বলেই হয়ত অজয় হোম এই দৌড়ে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যান। পাখিকে পাঠকের সামনে আনার বদলে পাঠককেই যেন লেখার মধ্য দিয়ে নির্জন অরণ্যে পাখিদের সামনে এন ফেলতেন তিনি। সমালোচকদের মতে, পাখির বৈশিষ্ট্য, গণ, প্রজাতি ইত্যাদি লেখার ক্ষেত্রে সংস্কৃত শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা ছিল অজয় হোমের। তদার্শ, চিরিটীক, শিলীন্ধ্রী, কলবিঙ্ক ইত্যাদি জটিল সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করেছেন তিনি তাঁর ‘বাংলার পাখি’ বইতে। কিন্তু সেই বইতে এই শব্দগুলির উৎস বা প্রকৃত অর্থের কোনো ব্যাখ্যা দেননি অজয়। এই ‘বাংলার পাখি’ বইটি এবং ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত ‘চেনা অচেনা পাখি’ বইটির কোনোটিতেই পাখিদের রঙিন ছবি ছিল না। অনেক পরে সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের ‘জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা’ গল্পে দেখা যায় পানিহাটিতে যাওয়ার পথে ফেলুদা জটায়ুকে একটি বাইনোকুলারের পাশাপাশি দুটি বই দিয়েছিলেন যার মধ্যে একটি ছিল সালিম আলির ‘ইণ্ডিয়ান বার্ডস’ এবং অন্যটি অজয় হোমের ‘বাংলার পাখি’। বলা হয়, পক্ষীবিদ অজয় হোমের প্রতি শ্রদ্ধাবশতই সত্যজিৎ রায় এই গল্পে তাঁর প্রসঙ্গ এনেছিলেন। অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম, মেজর ফ্র্যাঙ্কলিন, স্যামুয়েল টিক্‌ল কিংবা ভারতের সালিম আলির সঙ্গে এক গোত্রে উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। এছাড়া তাঁর অন্যান্য লেখার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘বিচিত্র জীব-জন্তু’ এবং একটি কল্পবিজ্ঞানের গল্প ‘মরণ ঘুম’। ‘সন্দেশ’, ‘দেশ’, ‘কিশোর জ্ঞান-বিজ্ঞান’, ‘মহানগর’, ‘আজকাল’ ইত্যাদি বহু পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন তিনি। ক্রিকেট নিয়ে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক লেখা লিখেছিলেন অজয় হোম।

প্রকৃতি সংরক্ষণ, পাখি দেখার পাশাপাশি ক্রিকেট খেলতেও ভালোবাসতেন অজয় হোম। আর সেই সঙ্গে বন্যপ্রাণীর ছবি তোলা, চলচ্চিত্র সমালোচনা, বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প লেখা কিংবা ব্রিজ খেলাতেও নিয়োজিত ছিলেন। বলা হয় অজয় হোম নিজে থেকে ব্রিজ খেলার একটি স্বকীয় পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন যাকে ‘হোমস থ্রি-স্টেজ ফর্মুলা’ বলা হয়। এই ব্রিজ খেলায় এতটাই দক্ষ ছিলেন তিনি যে দেশীয় স্তরের বিভিন্ন টুর্নামেন্ট জেতা তাঁর একটা নেশায় পরিণত হয়েছিল। রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক অনুরাগী শ্রোতা ছিলেন অজয় আর তার পাশাপাশি রান্না করার নেশাও পেয়ে বসেছিল তাঁকে। বলা যায় রান্না করা তাঁর অন্যতম প্রধান শখ ছিল। একইসঙ্গে বহু ভাষা জানা সত্ত্বেও বাংলা ভাষাতেই লেখালিখি করতে ভালোবাসতেন অজয়। তাঁর বিশ্বাস ছিল বাংলার অনুরাগী পাঠকদের উদ্দেশ্যে অজানা তথ্য, জ্ঞানভাণ্ডারের নানা দিক উন্মোচন করাই তাঁর কর্তব্য। রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুরাগী যেমন ছিলেন তিনি, তেমনই নিজেও গান গাইতে ভালোবাসতেন। বিখ্যাত গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে ও প্রভাস দের সঙ্গে একত্রে ‘একতারা’ নামে একটি গানের স্কুলও খুলেছিলেন অজয় হোম। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার প্রভাস দে আসলে ছিলেন মান্না দের কাকা। কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে তাঁর বাড়ির দোতলা থেকে তিনতলার সিঁড়ি পর্যন্ত ভরে ছিল তিরিশ-চল্লিশটি পাখির খাঁচা। পাখিদের সম্পর্কে নানা দেশ-বিদেশের ডাকটিকিটও সংগ্রহ করে রাখতেন তিনি। জানা যায়, আলিপুর চিড়িয়াখানার ভিতরে বাঘের সঙ্গে খেলা করতেন তিনি। তাছাড়া শিম্পাঞ্জিকে দুধ খাইয়ে মুখ মুছিয়ে দেওয়ার কাজেও অজয় হোমের নাম জড়িয়ে আছে, যদিও এই ছবিটি এখনও সঠিকভাবে উদ্ধার করা যায়নি।

১৯৬৫ ও ১৯৬৯ সালে সারা বাংলা সাহিত্যমেলায় সভাপতিত্ব করেছিলেন অজয় হোম। ‘ছায়াপথ’ নামের একটি সিনেমা পত্রিকা এবং ‘প্রকৃতি জ্ঞান’ নামের একটি পরিবেশ বিষয়ক পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন তিনি। তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘প্রকৃতি সংসদ’। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বহুল তথ্য দখলে ছিল বলে পুলিনবিহারী সেনের রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত প্রায় সব বইয়েরই প্রুফ দেখে দিতেন অজয় হোম আর তার পাশাপাশি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বিভিন্ন বই তাঁরই তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হতো।

১৯৯৬ সালে তাঁর লেখা ‘চেনা অচেনা পাখি’ বইটির জন্য রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হন অজয় হোম। তিনি ‘বার্ডম্যান অফ বেঙ্গল’ নামেই পরিচিত।  

তাঁর স্মৃতিতে মৃত্যুর শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ২০১৩ সালে ২ মে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদে অজয় হোমের কন্যা সুতপা রায়চৌধুরীর সভাপতিত্বে অজয় হোমের একটি তৈলচিত্র স্থাপিত হয়।

১৯৯২ সালের ৩০ অক্টোবর অজয় হোমের মৃত্যু হয়।     

One comment

আপনার মতামত জানান