সামসিং ভ্রমণ

সামসিং ভ্রমণ

ডুয়ার্সের চিরাচরিত নির্জন শান্ত প্রকৃতির অপরূপ শোভা আর অচেনা পাহাড়ি নদীর গায়ে ছোট ছোট বন নিয়ে গড়ে ওঠা এই সামসিং (Samsing)। এখান থেকেই শুরু হয়ে যায় নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যান। শহরের ধুলো-ধোঁয়া, নাগরিক কোলাহল থেকে বহুদূরে মোহময়ী প্রকৃতির মাঝে ছোট্ট একফালি গ্রাম সামসিং এক স্বপ্নের দেশ যেন।

জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার মহকুমার অন্তর্গত মাটিয়ালী সম্প্রদায় উন্নয়ন ব্লকেই রয়েছে এই গ্রামটি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিন হাজার ফুট উপরে জলপাইগুড়ি আর দার্জিলিং-এর সীমানায় থাকা এই গ্রামের সৌন্দর্য এককথায় অতুলনীয়। শিলিগুড়ি থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৮৩ কিলোমিটার।

সবুজ চা বাগান, পাহাড় আর অরণ্য প্রকৃতির সমাবেশে গড়ে উঠেছে এই সামসিং গ্রাম, যা আজও বহু পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় ভুটানের তুষারাবৃত পাহাড়। নেওরা ভ্যালি জাতীয় উদ্যান থেকে মাত্র ১৮ কিমি. দূরের এই গ্রামে ৪ হাজার জনেরও বেশি মানুষ বসবাস করেন। সারা বছরই এই গ্রাম কুয়াশায় ঢেকে থাকে, মাঝে মাঝে প্রবল বৃষ্টিপাত আর ঠাণ্ডা হাওয়ার স্রোত বয়ে যায়। এই অঞ্চলটি সামগ্রিকভাবে দুটি ভাগে বিভক্ত – প্রথম অংশ সামসিং বসতি অঞ্চল যার মধ্যে রয়েছে খাসমহল ও ফাঁড়ি এবং অন্য অংশটি হল সামসিং চা বাগান। সামসিং চা বাগান অঞ্চলটি জলপাইগুড়ি জেলার প্রশাসনিক মহলের অন্তর্ভুক্ত হলেও সামসিং বসতি অঞ্চলটি রয়েছে গোর্খাল্যান্ডের প্রশাসনের অধীনে। একসময় এখানকার চা বাগানগুলির দায়িত্বে ছিলেন ব্রিটিশরা। তারা এগুলিকে কুর্তি লাইন, নিউ স্কুল লাইন, গুম্বা লাইন, কমল ভবন লাইন, এমবিপি লাইন, পিপি লাইন, জংশন লাইন, সাহিল ভুজেল লাইন, মোচি লাইন, বাস লাইন, নারায়ণ লাইন, ফাগু লাইন ইত্যাদি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই চা বাগান অথবা পর্যটন দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত। মূলত চা আর কমলালেবু চাষ করাই এখানকার প্রধান জীবিকা। পাইন, শাল, সেগুনের রাজ্যে বিরল কিছু প্রজাপতিরও দেখা মিলবে এখানে। এখানকার প্রকৃতি যেন ছবির মত সুন্দর। সূর্যাস্তের সময় এখানকার পার্বত্য প্রকৃতি আর সবুজের আবহ সব মিলেমিশে যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি তৈরি করে।

উত্তরবঙ্গগামী যে কোনও ট্রেনে করে নিউ মাল জংশনে নেমে সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে মেটেলি হয়ে ৩০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় সামসিং। নিউ মাল জংশনে সব ট্রেনের স্টপেজ না থাকায় বিখ্যাত নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে সেখান থেকে বাসে চেপেও এখানে আসা যায়। তাছাড়া শিলিগুড়ির মিত্তাল বাসস্ট্যান্ড থেকে সামসিং-এর বাস ধরেও এখানে আসা যায়। কিন্তু সারাদিনে এই বাস মাত্র দুবার ছাড়ে বলে শিলিগুড়ি থেকে বাসে করে চালসা গিয়ে সেখান থেকে শেয়ার জিপ বা গাড়ি বুক করে সামসিং চলে যাওয়া যায়।

সামসিং-এ থাকার জন্য সবথেকে নির্ভরযোগ্য জায়গা পশ্চিমবঙ্গের বন উন্নয়ন নিগমের সামসিং ফরেস্ট রেস্ট হাউস। তাছাড়া আরও কতগুলি হোম স্টে, বেসরকারি হোটেল কিংবা লজও রয়েছে সামসিং-এ। তবে যেখানেই থাকুন না কেন, এখানে আসার আগে থেকে হোটেল বুক করে আসা দরকার। মূলত হোটেল বা লজের মানের উপর ভাড়া কম-বেশি হয়ে থাকে।

সামসিং-এর গ্রামগুলো, সামসিং-এর মনোরম প্রকৃতি, চা-বাগান এসবই এখানকার বিশেষ দ্রষ্টব্যের মধ্যেই পড়ে। ভারত-ভুটান সীমান্তের নির্জন এই গ্রামে খুব সহজেই অবসরযাপন করা যায়। কাছেই রয়েছে মূর্তি নদী। মূর্তি নদীর জলে পা ডুবিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে দিন শেষ করার অনাবিল আনন্দ অন্য কোথাও উপভোগ করা যাবে না। সূর্যাস্তের সময় এই নদীর রঙ নাকি আরও মোহময়ী হয়ে ওঠে। সামসিং-এ প্রচুর কমলালেবুর বাগান রয়েছে। শীতকালে এলে এখানকার কমলালেবুর উৎসব দেখার অভিজ্ঞতাও হয়ে যাবে। কাছাকাছি চা বাগানগুলিও ঘুরে দেখে আসা যায়। ট্রেকিং করতে ভালবাসেন যারা তারা এখানে ছোট দূরত্বের ট্রেকিং-ও করে নিতে পারেন। এছাড়া আশেপাশে সাইটসিইং হিসেবে সুন্তালেখোলা আর রকি আইল্যান্ড একই দিনে পরপর ঘুরে নেওয়া যায়। সামসিং থেকে এগুলি খুব বেশি দূরেও নয়। যাদের শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানির সমস্যা রয়েছে, তাদের পক্ষে ট্রেকিং না করাই দরকার। সামসিং-এ ঘুরতে এসে স্থানীয় উপজাতিদের সর্বদা শ্রদ্ধা করবেন। পিকনিকের নামে অযথা পাহাড়ি নির্জনতা ভেঙে হুল্লোড় করা উচিত নয়। পাহাড়ের পরিবেশ কখনই নোংরা করা উচিত নয়। সন্ধ্যাবেলায় বা রাত্রে এইসব অঞ্চলে হোটেলের বাইরে না বেরনোই ভাল।

বর্ষাকাল বাদ দিয়ে যে কোনও সময় সামসিং চলে আসা যায়। তবে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে এলে সবথেকে ভাল উপভোগ করা যায় এখানকার প্রকৃতিকে।

ট্রিপ টিপস

  • কীভাবে যাবেন – উত্তরবঙ্গগামী যে কোনও ট্রেনে করে নিউ মাল জংশনে নেমে সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে মেটেলি হয়ে ৩০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় এখানে। তাছাড়া নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমেও সেখান থেকে বাসে চেপে এখানে আসা যায়। শিলিগুড়ির মিত্তাল বাসস্ট্যান্ড থেকে সামসিং-এর বাস পাওয়া যায়। কিন্তু সারাদিনে এই বাস মাত্র দুবার ছাড়ে বলে শিলিগুড়ি থেকে বাসে করে চালসা গিয়ে সেখান থেকে শেয়ার জিপ বা গাড়ি বুক করে এখানে চলে যাওয়া যায়।
  • কোথায় থাকবেন –  এখানে থাকার জন্য সবথেকে নির্ভরযোগ্য জায়গা পশ্চিমবঙ্গের বন উন্নয়ন নিগমের সামসিং ফরেস্ট রেস্ট হাউস। তাছাড়া আরও কতগুলি হোম স্টে, বেসরকারি হোটেল কিংবা লজও রয়েছে এখানে।
  • কী দেখবেন –  সামসিং-এর গ্রাম, চা বাগান, কমলালেবুর বাগান, মূর্তি নদী এ সবই এখানকার বিশেষ দ্রষ্টব্যের মধ্যে পড়ে। এছাড়া সাইটসিং হিসেবে নিকটবর্তী সুন্তালেখোলা আর রকি আইল্যান্ডে ঘুরে আসা যায়।
  • কখন যাবেন – বর্ষাকাল বাদে বছরের যে কোনও সময় সামসিং আসা যায়। তবে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস এখানে আসার আদর্শ সময়।
  • সতর্কতা –   
    • যাদের শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানির সমস্যা রয়েছে, তাদের পক্ষে ট্রেকিং না করাই দরকার।
    • পিকনিকের নামে অযথা পাহাড়ি নির্জনতা ভেঙে হুল্লোড় করা উচিত নয়।
    • পাহাড়ের পরিবেশ কখনই নোংরা করা উচিত নয়।
    • সন্ধ্যাবেলায় বা রাত্রে এইসব অঞ্চলে হোটেলের বাইরে না বেরনোই ভাল।

আপনার মতামত জানান