নিকন ক্যামেরা কীভাবে বিশ্বখ্যাত হয়ে উঠল

নিকন ক্যামেরা কীভাবে বিশ্বখ্যাত হয়ে উঠল

ছবি তুলতে ভালোবাসেন? ক্যামেরা পছন্দ করেন? হরেক কিসিমের লেন্স ঘাঁটতে ঘাঁটতে ‘নিকন’ ক্যামেরা কিংবা নিকন লেন্সের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন নিশ্চয়ই কোনো না কোনো সময়। ক্যামেরার রাজা বলা হয় নিকনকে। জনপ্রিয়তার নিরিখে নিকন আজও সর্বাগ্রগণ্য। লেন্সের গুণমানের দিক থেকে নিকনের বিকল্প পাওয়া ভার। কিন্তু কীভাবে সমগ্র বিশ্বে জনপ্রিয় হল নিকন? জানলে অবাক হবেন, একজন-শুধুমাত্র একজনই গোটা পৃথিবীর কাছে নিকনকে পরিচিত করে তুলেছিল। ডেভিড ডগলাস ডানকান। নিজেই একদিন তিনি চমকে গিয়েছিলেন এই নিকন ক্যামেরার জাদুতে আর তারপর নিজেই সেই জাদুতে চমকিত হতে শিখিয়েছেন বিশ্বকে। কীভাবে সম্ভব হল এতকিছু? নিকন ক্যামেরার সঙ্গে প্রথম কীভাবে তাঁর পরিচয় হল? চলুন জেনে নেওয়া যাক।

‘লাইফ’ পত্রিকার চিত্রগ্রাহক ডেভিড ডগলাস ডানকান। তার আগে যদিও তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন কর্প্সের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, মূলত যুদ্ধকালীন ছবি তোলার দক্ষতার জন্য ‘পার্পল হার্ট’ পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। সময়টা ১৯৫০-এর দশক। সেই ডগলাস ডানকান জাপানে গিয়েছিলেন কিছু ঐতিহ্যবাহী চিত্রশিল্পের ছবি তোলার কাজে। তাঁকে সহায়তা করতেন জুন মিকি নামের এক তরুণ চিত্রসাংবাদিক। সেখানেই একদিন সন্ধ্যায় ঘটে গেল সেই চমক। জুন মিকি একটা ক্যামেরা হাতে নিয়ে ডগলাসের ঘরে এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমি কী আপনার একটা ছবি তুলতে পারি?’ আর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই খচ্‌ করে ছবি উঠে যায় ক্যামেরায়। অভিজ্ঞ চিত্রগ্রাহক ডগলাস জানতেন সন্ধ্যায় ঘর প্রায় অন্ধকার, তেমন আলো নেই। ফলে জুন মিকি বৃথাই সময় নষ্ট করছেন। কিন্তু চমক তখনও আসেনি। পরেরদিন সকালেই ডেভিড ডগলাস ডানকানের একটা ৮×১০ ইঞ্চি অসাধারণ ছবি এনে হাতে দেন জুন মিকি। চমকে ওঠেন ডগলাস। এ তো প্রায় অসম্ভব! এত কম আলোয় ছবি উঠলো, অথচ তারপরেও এত স্বচ্ছ, এত নিখুঁত, এত অসাধারণ সেই ছবি! অস্ফূটেই তাঁর মুখ দিয়ে বেরোলো, ‘পারফেক্ট শট!’ যথারীতি উত্তেজিত এবং উৎসাহিত হয়ে জানতে চাইলেন ডগলাস যে কোন ক্যামেরায় এমন অসাধ্যসাধন করলেন জুন মিকি। জুন জানান যে সেই ক্যামেরাটা যেমন সাধারণ, তেমনই লেন্সটাও অতি সাধারণ, স্থানীয় নিকন ক্যামেরা কোম্পানির তৈরি ‘নিক্‌কর’। ডগলাস স্বাভাবিকভাবেই কোনোদিন এই লেন্সের ব্র্যাণ্ডের নাম শোনেননি। তাই উৎসাহিত হয়ে তৎক্ষণাৎ এই কোম্পানির প্রেসিডেন্ট ডক্টর মাসাও নাগোকাকে ফোন করে বসলেন তিনি। আর অদ্ভুত সমাপতন, ফোনের ওপার থেকে সম্মতির সুরে ভেসে এলো, ‘চলে এসো’। কে জানতো তখন এই একটা ফোনই গোটা জাপানের অপটিক্‌স শিল্পের চেহারাটাই বদলে দেবে ভবিষ্যতে। তবে সেদিন ডগলাস একা সাক্ষাৎ করেননি নিকনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে, তাঁর সঙ্গে ছিলেন ‘লাইফ’ পত্রিকার আরেক চিত্রগ্রাহক হোরেস ব্রিস্টল। টোকিওয় নিকনের ওহি প্ল্যান্টে বসে দুই চিত্রগ্রাহকই তাঁদের লেইৎজ এবং জেইস্‌ লেন্সগুলির সঙ্গে তুলনা করছিলেন নিক্‌কর লেন্সের। প্রোজেকশন ইন্সপেকশন সরঞ্জামের সাহায্যে পরীক্ষা করে তাঁরা প্রত্যেকেই স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে নিক্‌কর লেন্সের গুণমান তুলনায় অনেক ভালো। তারপরেও পরীক্ষা বাকি ছিল। নিকন ৩৫ মিমি এফ / ৩.৫ লেন্স দিয়ে সপ্তাহখানেক রেখে পরীক্ষা করতে বলেন। আর প্রতিবারের স্ন্যাপ নেওয়ার সময় চমকিত হতে থাকেন ডগলাস। অবশেষে তাঁর নিজের লেইকা থ্রি-সি ক্যামেরায় তিনি নিক্‌কর লেন্স বসিয়ে নেন। পরীক্ষা তো হল, ডগলাস আর হোরেস দুজনেই স্বীকার করলেন যে নিকন ক্যামেরা বিশ্বে তুলনাহীন। কিন্তু ডগলাস এর প্রচার করলেন কীভাবে? তার জন্য বিশেষ কিছুই করতে হয়নি তাঁকে। না কাউকে বলা, না বিজ্ঞাপন দেওয়া কিচ্ছু না। শুধু পরের পর ছবি তুলে গিয়েছেন তিনি। নিক্‌কর লেন্সের মায়াবী জাদুতে সেটাই পত্রিকার পাতায় আকৃষ্ট করেছে পাঠককে-সম্পাদককে এবং বিশ্বের তাবড় চিত্রপ্রেমীদের। আর এই সবকিছুই শুরু হয় কোরিয়ান যুদ্ধ দিয়ে। না ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ডগলাস কোনো যুদ্ধ বাধাননি, কোরিয়ান যুদ্ধ শুরু হলে সেই যুদ্ধের ছবি তুলতে থাকেন ডগলাস। পুরো যুদ্ধকালীন সময়ে ডগলাস তাঁর লেইকা থ্রি-সি ক্যামেরায় বসিয়েছিলেন নিক্‌কর এসসি ৫০ মিমি এফ/১.৫ লেন্স। আর এর ফল পেতে বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি তাঁকে। ‘লাইফ’ পত্রিকার চিত্র-সম্পাদক খুব সহজেই এই নতুন লেন্সে তোলা ছবির গুণমান আলাদা করে চিনতে পেরেছিলেন। যথারীতি ছাত্র ভালো ফল করলে, তাঁকে অন্যান্য উৎসাহীদের কিছু টিপস দিতেই হয়। ডগলাসের টিপস পেয়ে আরো দুজন চিত্রসাংবাদিক কার্ল মিডান এবং হ্যাঙ্ক ওয়াকার কোরিয়ান যুদ্ধের ছবি তুলতে শুরু করেন নিক্‌কর লেন্স দিয়ে। হ্যাঙ্ক ওয়াকার তো একটা নিকন এস ক্যামেরা কিনেই ফেললেন। যে সময় কোরিয়ার যুদ্ধ শুরু হল, বাতাসের তাপমাত্রা পড়ন্ত বাজারে শেয়ার সূচকের মতো ক্রমশ নিম্নগামী, প্রায় -৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে এসে ঠেকেছে। ঐ তাপমাত্রায় অন্য যে কোনো ক্যামেরাই জমে যায়, কাজ করে না ঠিকঠাক। কিন্তু তাদেরকে অবাক করে দিয়ে হ্যাঙ্ক ওয়াকারের নিকন এস ক্যামেরা দিব্যি খোশমেজাজে ছবি তুলে গেল, বিখ্যাত সব ছবি তুলে ফেললেন ওয়াকার সেই বরফশীতল যুদ্ধ-উপত্যকায়। ১৯৫০-এর পরে ‘ইউএস ক্যামেরা অ্যানুয়াল’ পত্রিকায় লেখা হল ডগলাস, ওয়াকার এবং মিডান এই ত্রয়ী চিত্রগ্রাহকই কোরিয়ান যুদ্ধের সবথেকে ভালো ছবি তুলেছেন। ব্যস! খবর রটে গেল চারিদিকে। ঐ কোরিয়ার যুদ্ধের সময়কার সব চিত্রসাংবাদিক একে একে কিনতে শুরু করলেন নিক্‌কর লেন্স, নিকন ক্যামেরা। জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগলো নিকনের। এখানে আরেকটা ব্যবসায়িক বুদ্ধি খাটিয়েছিল নিকন। কিছু দিলে তবেই তো কিছু পাওয়া যায়। ক্যামেরা বা লেন্স তৈরির পাশাপাশি নিকন কোম্পানি ক্যামেরা সারানো বা পরিস্কার করার কাজও শুরু করে। কোরিয়ান যুদ্ধের সময় টোকিওর প্রেস ক্লাব সেন্টারে রোজই প্রায় গাড়ি পাঠিয়ে সাংবাদিকদের ক্যামেরা নিতে আসতো নিকন কোম্পানি আর এক রাতের মধ্যেই তা সারিয়ে, পরিস্কার করে ফেরত দিয়ে যেত ফের পরদিন ভোরে। একেবারে বিনামূল্যে, যেন খুব কাছের বন্ধু। যেকোনো ক্যামেরা তা সে রোলিফ্লেক্স হোক, লেইকা হোক বা জেইস্‌ হোক, এক রাতের মধ্যেই ঠিকঠাক করে পাঠিয়ে দিত নিকন। আর এটাই ছিল ঐ সময়ে কোম্পানির সবথেকে বড়ো ব্যবসায়িক উত্থানের সিঁড়ি।

ততদিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। জাপান বিধ্বস্ত। আমেরিকার যুদ্ধজয়ের উল্লাস জাপান তখনও ভোলেনি আর সেই যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি মিটিয়ে নিয়েছিল জাপান একপ্রকার ব্যবসায়িক জয়ে। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নিকন ক্যামেরার বিপুল জনপ্রিয়তায় আমেরিকার ইস্টার্ন অপটিকাল কোম্পানির বিশেষজ্ঞরা উৎসাহী হয়ে পড়েন জাপানের এই প্রযুক্তিতে। ক্যামেরার বিক্রি এত বেড়ে যায়, জাপানের ভেঙে পড়া অর্থনীতি আবার সচ্ছল হতে শুরু করে অপটিক্‌স শিল্পের হাত ধরে। পত্রিকার পাতায় পাতায় লেখা হয়, এই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বহু সাংবাদিক জার্মান ক্যামেরা ছেড়ে জাপানি ক্যামেরা ব্যবহারের দিকে আগ্রহী হয়েছেন আর এই কৃতিত্বের দাবিদার স্বয়ং নিকন। সবথেকে বড়ো ব্যাপার ছিল, এত ক্ষুদ্র পরিসরে ক্যামেরার অংশগুলি সজ্জিত থাকতো নিকনে যে তা সহজেই আকৃষ্ট করতো চিত্রগ্রাহকদের, জার্মান মিনিয়েচার শিল্পের দক্ষতাকেও হার মানিয়েছিল নিকন। মাত্র এক বছরের মধ্যেই যে কোম্পানির নাম প্রায় কেউই জানতো না, তার নামই ছড়িয়ে পড়লো গোটা পশ্চিমি বাজারে। ক্যামেরার দুনিয়ায় একমাত্র আইকন – নিকন। ফলে একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে একা ডগলাস ডানকানই নিকনকে বিশ্বের বাজারে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। এক সন্ধ্যার চমক, একটা ফোন আর দুনিয়া বদলে গেল নিকনের হাত ধরে।

তথ্যসূত্র


  1. Nikkon at 100, ‘Amatuer Photographer’, 8 July 2017
  2. https://www.nikonownermagazine.com/
  3. https://www.mikeeckman.com/
  4. https://www.youtube.com/

আপনার মতামত জানান