প্রমথনাথ চৌধুরী

প্রমথনাথ চৌধুরী

বাংলা সাহিত্যে ‘বীরবল’ বলেই তাঁকে চেনে অধিকাংশ পাঠক। বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলা গদ্যের জগতে এক নতুন পথের দিশা সৃষ্টি করে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন বাংলার ‘বীরবল’ প্রমথনাথ চৌধুরী (Pramatha Nath Chaudhuri)। ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তাঁর পরিচয়ের পাশাপাশি দক্ষ প্রাবন্ধিকের পরিচিতিই স্বাতন্ত্র্য এনে দিয়েছে প্রমথনাথ চৌধুরী ওরফে প্রমথ চৌধুরীকে। বলা যায় তিনিই বাংলা সাহিত্যে নবযুগের পথিকৃৎ। একইসঙ্গে সংস্কৃতে সুপণ্ডিত প্রমথনাথ চৌধুরী ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাঁর পাণ্ডিত্য এবং সুমধুর রসবোধ ছাপ ফেলেছে তাঁর প্রবন্ধগুলিতে। সমালোচকদের মতে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব থাকলেও উনিশ শতকের গদ্যভাষার থেকে অনেকাংশেই বদল ঘটাতে পেরেছিলেন প্রমথ চৌধুরী।

১৮৬৮ সালের ৭ আগস্ট পাবনার হরিপুর গ্রামের এক উচ্চবংশীয় জমিদার পরিবারে প্রমথনাথ চৌধুরী -এর জন্ম হয়। তাঁর বাবা দুর্গাদাস চৌধুরী হরিপুর গ্রামের জমিদার ছিলেন এবং তাঁর মা সুকুমারী দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় বোন। ফলে সম্পর্কের দিক থেকে প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বোনপো। প্রথম পাঁচ বছর হরিপুর গ্রামে থাকার পরে তাঁদের পরিবার চলে আসে নদীয়ার কৃষ্ণনগরে এবং সেখানেই পরবর্তী দশটি বছর অতিবাহিত হয় প্রমথ চৌধুরীর। এই কৃষ্ণনগরেই একসময় রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র বাস করতেন এবং তিনি অন্নদামঙ্গল রচনা করেছিলেন এখানেই। ফলে এই পরিবেশে প্রমথ চৌধুরীর মধ্যে সাহিত্য-প্রীতি সঞ্চারিত হয়। তাঁর বাবার বদলির কারণে বাংলা, বিহারের বহু জায়গাই ছোটোবেলায় তাঁর ঘোরা হয়ে গিয়েছিল। জমিদারির পাশাপাশি তাঁর বাবা দুর্গাদাস ব্রিটিশ সরকারের অধীনস্থ উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন এবং হিন্দু কলেজের ছাত্র হওয়ার সুবাদে তাঁর সংগ্রহে প্রচুর বইপত্র ছিল। ছোটো থেকেই একটা নাস্তিক পরিমণ্ডলে প্রমথ চৌধুরী বড়ো হয়েছেন। একইসঙ্গে গ্রাম্য ও নাগরিক জীবন এবং সামন্ততান্ত্রিক পরিকাঠামোর পাশাপাশি উদার-মনস্ক চিন্তা-চেতনার প্রভাব পড়েছিল তাঁর কিশোর মনে। ছোটোবেলায় গান গাইতে ভালোবাসতেন প্রমথ যে প্রতিভা জন্মগতভাবে তিনি পেয়েছিলেন রবীন্দ্র-ভগিনী তাঁর মায়ের থেকে।  

পাঠশালায় প্রচলিত চারুপাঠ শেষ করে কৃষ্ণনগরের দেবনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রমথ চৌধুরীর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়। তারপর একটি খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে কিছুদিনের জন্য ভর্তি হন তিনি এবং  বাবার পুনরায় বদলি হলে স্থানীয় কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা করেন প্রমথ চৌধুরী। মোট ছয়টি স্কুলে নানা সময় পড়াশোনা করেছেন তিনি। ১৮৮১ তিনি যখন প্রবেশিকা পরীক্ষা দেবেন, কৃষ্ণনগরে ম্যালেরিয়া মহামারী আকারে দেখা দিল। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রমথ চৌধুরী বাবার সঙ্গে বিহারের আরা-তে চলে আসেন। এই সময়কালে তিনি পাঠ্যপুস্তক সব সরিয়ে রেখে বুলওয়্যার লিটন, জর্জ এলিয়টের উপন্যাস আর প্যালগ্রেভসের গোল্ডেন ট্রেসারি পড়ে ফেলেন। ১৮৮২ সালে কলকাতায় ফিরে হেয়ার স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম স্থানে উত্তীর্ণ হন প্রমথ চৌধুরী আর তারপরে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন উচ্চশিক্ষার জন্য। কিন্তু এখানেও বেশিদিন পড়তে পারেননি তিনি। কলকাতায় হঠাৎ ডেঙ্গু মহামারীর উপদ্রব শুরু হলে তিনি কৃষ্ণনগর কলেজে কলাবিদ্যার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন। পরে আবার জ্বরে পড়লে বাবার সাথে বাধ্য হয়েই তাঁকে পড়াশোনার ইতি ঘটিয়ে দিনাজপুরে চলে যেতে হয়। ইতিমধ্যে দাদা আশুতোষ চৌধুরীর উৎসাহে ফরাসি ভাষা শিখতে শুরু করেন তিনি। তারপরে ১৮৮৭ সালে কলকাতায় ফিরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে কলাবিদ্যায় দ্বিতীয় স্থানে উত্তীর্ণ হন প্রমথ চৌধুরী। ১৮৮৮ সালে পুনরায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন তিনি এবং ঐ বছরই দর্শনে প্রথম বিভাগে স্নাতক উত্তীর্ণ হন প্রমথ চৌধুরী। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে তিনি স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ১৮৯৩ সালে ইংল্যাণ্ডে তিন বছর পড়াশোনা করে লণ্ডনের বিখ্যাত ইনার টেম্পলের আহ্বানে ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল পাশ করেন প্রমথ। 

আইন পরীক্ষায় পাশ করে উকিল আশুতোষ ধরের অফিসে কেরানির কাজে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়েই প্রমথ চৌধুরীর কর্মজীবন শুরু হয়। পরে ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল হওয়ার সুবাদে কলকাতা হাইকোর্টেও তিনি কিছুদিন আইনজীবী হিসেবে প্র্যাক্টিস করেছিলেন। কিন্তু কখনোই এই পেশাকে গুরুত্ব দেননি সেভাবে। কিছুদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ কলেজেও অধ্যাপনা করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী। বহরমপুর কলেজ এবং কোচবিহার কলেজ থেকে অধ্যাপনার আহ্বান এলেও তিনি সেই ডাকে সাড়া দেননি।

তবে তাঁর কর্মজীবনের মূল অধ্যায় কেন্দ্রীভূত ছিল সাহিত্য-সাধনায়। ১৮৯০ সাল থেকে ১৮৯৩ সালের মধ্যেই প্রমথ চৌধুরীর দুটি প্রবন্ধ এবং দুটি গল্প প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ‘ফুলদানি’ গল্প এবং ‘টরকুয়্যেটো ট্যাসো এবং তাঁহার সিদ্ধ বেতালের কথোপকথন’ নামক প্রবন্ধটি উল্লেখযোগ্য। উল্লিখিত প্রবন্ধটি আসলে ইতালীয় প্রবন্ধের অনুবাদ যা প্রকাশিত হয়েছিল সাধনা পত্রিকায় ১৮৯৩ সালে। ১৮৯০ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় প্রমথ চৌধুরীর অত্যন্ত বিখ্যাত এবং প্রথম মৌলিক প্রবন্ধ ‘জয়দেব’ যেখানে সাহিত্যের ইতিহাসে গীতগোবিন্দ রচয়িতা জয়দেবকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাননি। এমনকি জয়দেবকে তিনি খুব একটা উঁচুদরের সাহিত্যিক বলেও মনে করতেন না। ১৯০২ সালে ভারতী পত্রিকার পাতায় প্রথম তাঁকে ‘বীরবল’ ছদ্মনামে লিখতে দেখা যায়, রচনাটির নাম ছিল ‘খেয়াল খাতা’। এরপর ১৯০৮ সালে প্রমথ চৌধুরী লেখেন ‘এক টুকরো স্মৃতিকথা’। বাংলা গদ্যের প্রকৃতি তাঁর হাত ধরেই ক্রমবিবর্তিত হচ্ছিল। বাংলা কথ্য চলিতের প্রয়োগ লক্ষ করা যাচ্ছিল তাঁর লেখায় আর সেটাই হয়ে উঠলো বীরবলীয় স্বতন্ত্র গদ্য। ১৯১৪ সালে প্রকাশ পায় প্রমথ চৌধুরীর সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ পত্রিকা যা বাংলা সাহিত্যে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। অনেক সমালোচক একে সবুজপত্র বিপ্লবও বলে থাকেন। তবে সবুজপত্র প্রকাশের আগে প্রমথ চৌধুরীর বেশ কিছু রচনা প্রকাশ পেয়েছিল সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত ‘সাহিত্য’ পত্রিকা, ঠাকুরবাড়ির ‘সাধনা’ পত্রিকা, ‘ভারতী’ পত্রিকা ইত্যাদিতে। ১৯১২ সালে ভারতী পত্রিকায় প্রমথ চৌধুরীর দুটি বিখ্যাত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় যথাক্রমে – ‘বঙ্গভাষা বনাম বাবু বাংলা ওরফে সাধু ভাষা’ এবং ‘সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা’। বঙ্কিমের পরে তাঁর হাত ধরেই বাংলা গদ্য যেন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠে। ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে চিন্তা করেছেন প্রমথ চৌধুরী আর তাঁর সেই চিন্তার ফসলরূপে প্রকাশ পায় ‘মলাট সমালোচনা’, ‘কথার কথা’ ইত্যাদি প্রবন্ধগুলি। ১৯১৩ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় তিনি লেখেন ‘বাংলা সাহিত্যের নবযুগ’ নামের একটি প্রবন্ধ যেখানে তিনি আধুনিক বাংলা ভাষার জনমুখী প্রবণতার কথা উল্লেখ করেছিলেন। ঐ বছরই প্রকাশ পায় প্রমথ চৌধুরীর প্রথম কবিতার বই – ‘সনেট পঞ্চাশৎ’ যা সাহিত্যজগতে চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই কাব্যগ্রন্থের প্রশংসা করেন। ফরাসি সাহিত্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও বাংলায় এমন উন্নতমানের সনেট লিখে প্রমথ চৌধুরী আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর লেখা কবিতাগুলির মধ্যে ‘বালিকা বধূ’, ‘বার্নার্ড শ’, ‘দ্বিজেন্দ্রলাল’, ‘ব্যর্থ জীবন’, ‘উপদেশ’, ‘আত্মকথা’, ‘তাজমহল’ ইত্যাদি খুবই উল্লেখযোগ্য। এরপর বলতেই হয় ‘সবুজপত্র’-এর কথা। ১৯১৪ সালের এপ্রিল মাসে প্রমথ চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সবুজপত্র সাময়িক পত্রিকা। প্রথম পর্যায়ে এটি ১৯২২ সাল পর্যন্ত এবং পরে দ্বিতীয় পর্যায়ে এটি ১৯২৭ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। কোনোরকম বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হতো না এই পত্রিকায়, এমনকি সম্পাদক হিসেবে প্রমথ চৌধুরী একে কোনোরকম বাণিজ্যিকীকরণের চেষ্টাও করেননি। এই ‘সবুজপত্র’কে কেন্দ্র করে একটি লেখকগোষ্ঠী গড়ে ওঠে যাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন মধ্যমণিসম। প্রমথ চৌধুরীর অন্যতম বিখ্যাত এবং আলোচিত গল্পগ্রন্থ হল ‘চার-ইয়ারি কথা’ যা প্রকাশ পায় ১৯১৬ সালে। এখানে চারটি পৃথক চরিত্রের মুখ দিয়ে চারটি আলাদা আলাদা গল্প বলিয়েছেন লেখক যার ভাষারীতি, প্লট বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে একেবারে অভিনব ছিল। ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী যদিও এই গল্পের সমালোচনাকালে এতে রুডইয়ার্ড কিপ্লিং-এর ভাষাশৈলীর প্রভাব লক্ষ করেছেন। তাঁর অন্যান্য গল্পগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘আহুতি’ (১৯১৯), ‘নীল লোহিত’ (১৯৩২), ‘নীল লোহিতের আদি প্রেম’ (১৯৩৪), ‘ঘোষালের ত্রি-কথা’ (১৯৩৭) এবং ১৯৪১ সালে প্রকাশিত ‘গল্পসংগ্রহ’। তবে তাঁর পরিচিতি মূলত প্রাবন্ধিক হিসেবে। তেল-নুন-লক্‌ড়ি (১৯০৬), নানা কথা (১৯১৯), বীরবলের টিপ্পনী (১৯২০), বীরবলের হালখাতা (১৯২০), ঘরে বাইরে (১৯৩৬) ইত্যাদি প্রমথ চৌধুরীর লেখা অত্যন্ত উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ। পরবর্তীকালে ১৯৪৬ সালে তিনি আত্মকথা নামে একটি আত্মজীবনী লেখেন। ১৯১৯ সালে ‘পদাচারণ’ নামে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থটি তিনি ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে উৎসর্গ করেছিলেন। বিশ শতকে বাংলা গদ্যের বিকাশে প্রমথ চৌধুরীর অবদান ছিল সর্বাগ্রে উল্লেখ্য।

১৯৪৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর প্রমথ চৌধুরীর মৃত্যু হয়।

2 comments

আপনার মতামত জানান