নীলরতন সরকার

নীলরতন সরকার

নীলরতন সরকার (Nilratan Sircar) একজন প্রবাদ প্রতিম ভারতীয় বাঙালি চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদ যিনি বাংলার বহু শিক্ষা এবং গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানের উন্নতিকল্পে জড়িত ছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই ভারতের চিকিৎসাজগতে এক আধুনিক যুগের সূচনা হয়। তৎকালীন বিদেশি চিকিৎসকদের আধিপত্যের মধ্যেও তিনি নিজের দক্ষতা প্রমাণ করে ভারতবর্ষের চিকিৎসকদের মধ্যে প্রথম সারিতে জায়গা করে নেন। কর্মসংস্হানের লক্ষ্যে তাঁর উদ্যোগে বহু শিল্প স্হাপিত হয়েছে বাংলায়। বাঙালিদের মধ্যে ডাক্তারি শিক্ষার প্রসারে নীলরতন সরকারের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তাঁর সারাজীবনের স্বীকৃতি স্বরূপ ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজের নাম পরিবর্তন করে ‘নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ’ হিসেবে নামাঙ্কিত করা হয়।

১৮৬১ সালের ১ অক্টোবর দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার নেতড়া গ্রামে এক দরিদ্র কায়স্হ পরিবারে নীলরতন সরকারের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম নন্দলাল সরকার ও মায়ের নাম থাকোমণি দেবী। তাঁদের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের যশোহর জেলায়। নীলরতন সরকারের ভাই যোগীন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন বিখ্যাত একজন শিশুসাহিত্যিক। বিখ্যাত রাশিবিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ছিলেন সম্পর্কে নীলরতন সরকারের বোনপো। ঝড়ের কারণে নেতড়া গ্রামে তাঁদের বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাঁর বাবা নন্দলাল সরকার পুরো পরিবার নিয়ে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার জয়নগরে শ্বশুরবাড়িতে চলে আসেন। নীলরতনের যখন চোদ্দো বছর বয়স, তখন তাঁর মা থাকোমণি দেবী বিনা চিকিৎসায় মারা যান আর সেই থেকেই ছোট্ট নীলরতন জীবনের লক্ষ্য স্হির করেন ডাক্তার হয়ে গরীব অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াবেন তিনি।

জয়নগরের বহড়ু হাইস্কুলে নীলরতনের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। এই বিদ্যালয় থেকে ১৮৭৬ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। এরপর তিনি কলকাতায় ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হন ডাক্তারি পড়ার জন্য। ১৮৮১ সালে দেশীয় ভাষায় ডাক্তারি এল.এম.সি পাস করেন। কিন্তু ১৮৮৫ সালে ক্যাম্পবেল স্কুলের তৎকালীন সুপার ম্যাকেঞ্জি সাহেবের সুপারিশে ‘বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ’-এ ভর্তি হন তিনি যা এখন ‘কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ’ নামে পরিচিত। ক্যাম্পবেল স্কুলের রেজাল্ট তাঁর এতটাই ভালো ছিল যে ‘বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ’-এ সরাসরি তৃতীয় বর্ষে ভর্তি হন নীলরতন সরকার এবং সেখান থেকে ‘গুডিভ স্কলারশিপ’ লাভ করেন। ১৮৮৮ সালে তিনি এম. বি পাশ করেন। তারপর ১৮৮৯ সালে মেয়ো হাসপাতালে হাউজ সার্জেন হিসেবে নিযুক্ত থাকার পাশাপাশি তিনি একাধারে এম. এ পাস করেন এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে বাঙালিদের মধ্যে ষষ্ঠ এম. ডি হন।

চাতরা হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হয়ে নীলরতন সরকারের কর্মজীবন শুরু হয়। এরপর কলকাতায় অঘোরনাথ বিদ্যালয়ে তিনি কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। এখানে তিনি সহকর্মী হিসেবে পান নরেন্দ্রনাথ দত্তকে অর্থাৎ যাকে আমরা চিনি স্বামী বিবেকানন্দ হিসেবে। সেসময় ডাক্তারি পড়ার জন্য বাঙালিদের জন্য বাংলায় পঠনপাঠনের পৃথক ব্যবস্হা থাকলেও দেশীয় ভাষায় ডাক্তারি পাশ করে কেবলমাত্র অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জনের চাকরি পাওয়া যেতো আর তাই পদমর্যাদার এই বৈষম্যে আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হলে পেশা পরিবর্তন করে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছিলেন নীলরতন। তৎকালীন বাংলার ছোটলাট কারমাইকেলের কাছে গিয়ে স্বদেশি মেডিক্যাল কলেজ তৈরি করার আর্জি জানান তিনি। কিন্তু কোষাগারের শোচনীয় অবস্থার কথা জানিয়ে ছোটলাট তাঁকে জানান যে নীলরতন যদি একমাসের মধ্যে এক লক্ষ টাকা জোগাড় করতে পারেন, তবেই একমাত্র কলেজ তৈরি করা সম্ভব হবে। সেইমতো মাত্র এক মাসের মধ্যে তৎকালীন বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ও রোগীদের সাহায্যে তিনি এক লক্ষ টাকা জোগাড় করে ফেলেন এবং ১৮৯৫ সালে ১৬৫ নং বৌবাজার স্ট্রিটের ভাড়াবাড়িতে ‘কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যাণ্ড সার্জনস অব বেঙ্গল’ তৈরি হয় যা বাংলার ইতিহাসে প্রথম বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ। স্বদেশি ভাষায় ডাক্তারি কলেজ তৈরি করার লক্ষ্যে নীলরতনের দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডা. রাধাগোবিন্দ কর ও ডা. সুরেশ সর্বাধিকারীর সঙ্গে মিলিতভাবে ১৮৮৭ সালে ১১৭ নং বৌবাজার স্ট্রিটের বাড়িতে ‘ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ’ তৈরি করেন নীলরতন সরকার। ১৮৯০ সালে মেয়ো নেটিভ হাসপাতালে হাউজ সার্জেনের পদে যোগদান করে ডাক্তারি জীবন শুরু করেন নীলরতন সরকার। এখানে তাঁর প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি ৬১ নং হ্যারিসন রোডে নিজের বাড়িতে চেম্বার খোলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই চিকিৎসক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন নীলরতন সরকার। সেই সময় দেশীয় চিকিৎসকরা সাহেব চিকিৎসকদের দাপটে দু টাকা বা চার টাকা ভিজিটে রোগী দেখতেন আর বিপরীতে সাহেব ডাক্তারদের ভিজিট ছিল ষোলো টাকা থেকে চৌঁষট্টি টাকা। মূলত সাহেব ডাক্তারদের আধিপত্য হ্রাস করার জন্যই নীলরতন ষোলো টাকা ভিজিট নিয়ে রোগী দেখতে শুরু করেন। ক্রমশ তাঁর পারিশ্রমিক চৌঁষট্টি টাকায় এসে পৌঁছায়। পাঁচ দশক ধরে তিনি ভারতবর্ষের চিকিৎসকদের মধ্যে শীর্ষস্থানে ছিলেন। রোগীদের কাছে তিনি ঈশ্বরের সমতুল্য নীলরতন দরিদ্র মানুষকে বিনা পারিশ্রমিকে নিজের বাড়িতে এনে চিকিৎসা করতেন এবং তাদের বিনামূল্যে ওষুধ ও পথ্য দিতেন।

নীলরতন স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বনির্ভর ভারতবর্ষ গড়ে তোলার। অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও দারিদ্র্য থেকে মুক্ত এক ভারতবর্ষ গড়ার উদ্দেশ্যেই তিনি স্বদেশি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। বিপুল অর্থ রোজগার করতে শুরু করেন নীলরতন স্বদেশি শিল্প গড়ার লক্ষ্যে আর তাঁর এই কর্মযজ্ঞের সঙ্গী ছিলেন তাঁর পরম বন্ধু আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তাঁরা দুজনেই কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে শিল্প তৈরিতে উদ্যোগী হন এবং তাঁদের যৌথ উদ্যোগে ১৯০৫ সালে আপার সার্কুলার রোডে ‘বিজয়া’ সাবান কোম্পানি তৈরি হয়। আসামে গিয়ে নীলরতন একটি চা বাগান কিনে ‘রাঙামাটি’ চা কোম্পানি শুরু করেন। ‘ন্যাশনাল ট্যানারি’ গঠনে তিনি বহু অর্থ বিনিয়োগ করেন।

১৯০৪ সালে নীলরতন সরকারের প্রতিষ্ঠিতি ‘ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ’ এবং ‘কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যাণ্ড সার্জনস অব বেঙ্গল’ মিলিত হয়ে বেলগাছিয়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল গড়ে ওঠে, পরে যার নামকরণ হয় ‘কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ’। এই হাসপাতাল বর্তমানে আর. জি. কর মেডিক্যাল কলেজ নামে পরিচিত। ১৯১৮ সালে কারমাইকেল কলেজের দেখাশোনার জন্য মেডিক্যাল এডুকেশন সোসাইটি গঠিত হলে নীলরতন সরকার তার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত এই পদে আসীন ছিলেন তিনি।

যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ’-এর প্রতিষ্ঠাতেও নীলরতনের প্রভূত উদ্যোগ ছিল যার আগে নাম ছিল ‘বেঙ্গল টেকনোলজিকাল ইনস্টিটিউট’। ১৯২৮ সালে ডাক্তার কুমুদশঙ্করের সঙ্গে একযোগে তিনি গড়ে তোলেন বাংলার প্রথম যক্ষ্মা হাসপাতাল। নিজের ৭নং শর্ট স্ট্রিটের বাড়িতে তিনি একটি ল্যাবরেটরি খুলে বিদেশ থেকে প্রথম ই.সি.জি মেশিন এনে ভারতে প্রথম তা ব্যবহার শুরু করেন নীলরতন সরকার। কিছু মেডিক্যাল জার্নাল নিয়মিত আনাতেন তিনি জুনিয়র ডাক্তারদের পড়ার সুবিধার জন্য। শুধু তাই নয়, নিজ উদ্যোগে তিনিই প্রথম শিশুমৃত্যু রোধ করার জন্য ‘দাই মা’দের প্রশিক্ষণের ব্যবস্হা করেন আর তাঁর এই কাজের জন্য ১৯১৫ সালে তিনি ‘চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির’ সভাপতি নির্বাচিত হন।

শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান আজও স্মরণীয়। ১৮৯৩ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য নির্বাচিত হন এবং সেই বছরই ‘ফ্যাকাল্টি অফ সায়েন্স’ ও ‘ফ্যাকাল্টি অফ ডিন’ পদে আসীন হন তিনি। ১৯০৮ সালে ‘বুট অ্যাণ্ড ইকুইপমেন্ট’ সংস্থার নির্দেশক ছিলেন নীলরতন সরকার। ১৯১২ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত তিনি ‘বঙ্গীয় ব্যবস্হাপক সভা’র সদস্য ছিলেন। ১৯২৪ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর কলা বিভাগের এবং ১৯২৪ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি হয়েছিলেন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে আসীন ছিলেন নীলরতন সরকার ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত। ‘সায়েন্স কলেজ অফ ক্যালকাটা ইউনির্ভাসিটি’ এবং ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশন’ স্হাপনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নেন।

চিকিৎসার ক্ষেত্রে তাঁর সারাজীবনের অবদানের জন্য অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি তাঁকে দিয়েছিল ‘ডক্টরেট অফ সিভিল ল’ ডিগ্রি আর এডিনবরা ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি পেয়েছিলেন ‘ডক্টরেট অফ লেজিসলেটিভ ল’ ডিগ্রি। ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজ পরবর্তীকালে তাঁর নামেই নামাঙ্কিত হয় ‘নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ’।

নীলরতন সরকার এবং রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পরম বন্ধু। রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক চিকিৎসক ও উপদেষ্টাও ছিলেন তিনি। ‘সেঁজুতি’ কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর পরম বন্ধু নীলরতন সরকারকে উৎসর্গ করেছিলেন। নীলরতন সরকারের যোগ্য ছাত্র হিসেবে পরবর্তীকালে ডা. বিধান রায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি চিকিৎসক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

১৯৪৩ সালের ১৮ মে গিরিডিতে নীলরতন সরকারের মৃত্যু হয়।

4 comments

আপনার মতামত জানান