জাতীয় উৎপাদনশীলতা দিবস

২ অক্টোবর ।। জাতীয় উৎপাদনশীলতা দিবস (বাংলাদেশ)

প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশেই কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের পালনীয় সেই সমস্ত দিবসগুলির মধ্যেই একটি হল জাতীয় উৎপাদনশীলতা দিবস (National Productivity Day)।

প্রতি বছর ২ অক্টোবর তারিখে সারা বাংলাদেশ জুড়ে জাতীয় উৎপাদনশীলতা দিবস পালিত হয়। দেশের শিল্প, কৃষি, চিকিৎসা ও সেবা সহ আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায় সেজন্য জনসচেতনতা প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে এই দিনটি বিশেষ সমারোহে পালিত হয়। একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার দরুন বিভিন্ন খাতে উৎপাদন বাড়লে সামগ্রিকভাবে দেশের জিডিপিও বৃদ্ধি পাবে এবং উৎপাদনশীলতার উপর প্রতিটি দেশবাসীর আর্থিক সঙ্গতি নির্ভরশীল। দেশের উন্নয়নকে টিকিয়ে রাখতে গেলে আরো বেশি পরিমাণ উৎপাদন প্রয়োজন আর সেই লক্ষ্যেই সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমস্ত ক্ষেত্রের কর্মীদের সচেতন করে তুলতে বাংলাদেশে প্রতি বছর এই বিশেষ দিনটি পালিত হয়ে থাকে।

২০১২ সালে প্রথম বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার শিল্পমন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে জাতীয় উৎপাদনশীলতা দিবস পালন করেছিল। সাধারণত দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের কর্মী, শ্রমিক এবং কৃষকরাই সরাসরিভাবে উৎপাদনশীলতার সঙ্গে জড়িত। উৎপাদনশীলতা বলতে বেশি পরিমাণ পণ্য তৈরি নয়। ‘এশিয়ান প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশন’-এর মতে, উৎপাদনশীলতা একটি মানসিক অবস্থা যা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে বর্তমান অবস্থার তুলনায়। এটা একটা বিশ্বাসের মতো যে একজন মানুষ আজকের তুলনায় আগামীকাল আরো ভালো কাজ করতে সক্ষম হবে। এই উৎপাদনশীলতা শুধু দেশের নয়, প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের নিজের জীবনকে আরো উন্নততর করে তোলার পথে অন্যতম সহায়ক। সমগ্র বিশ্বের ইতিহাস দেখলে ১৯৫৫ সালে জাপান মূলত তিনটি নীতি নিয়ে এই উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সক্ষম হয়েছিল যার মধ্যে চাকরির নিশ্চয়তা এবং বেশিমাত্রায় কর্মসংস্থান, কর্তৃপক্ষ ও কর্মীর যৌথ আলোচনায় পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সর্বোপরি উৎপাদনশীলতার ফলের সমবন্টন। বাজার অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই তিনটি নীতিই কোনো দেশের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়তা করে। জাপানের পাশাপাশি সিঙ্গাপুরও ১৯৬০ সাল থেকে এই উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়েছে এবং এরকমভাবে সিঙ্গাপুর, মরিশাস সমস্ত দেশেই সামগ্রিক অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে তুলতে উৎপাদনশীলতা প্রকল্পে মনোনিবেশ করা হয়েছে। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশও এই এশিয়ান প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং এর ফলে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রকের অধীনে ১৯৮৯ সালে গঠিত হয়েছে ‘ন্যাশনাল প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশন’। জাতীয় উৎপাদনশীলতা সংক্রান্ত নানা নীতি প্রণয়ন, পরিকল্পনা ও প্রয়োগের কাজটি করে থাকে এই সংস্থা। বাংলাদেশের জাতীয় উৎপাদনশীলতা দিবস পালনের পরিকল্পনাটিও এই সংস্থারই। স্বাধীনতার পর থেকে নানা সময় বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। বিশ্ব বাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাণিজ্যকে সফল করে তোলার প্রয়াসে বাংলাদেশ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দিকেই বেশি মনোযোগ দিয়েছে আর এই কারণেই নানা সময় দেশ জুড়ে উৎপাদনশীলতা প্রচার-অভিযান চালিয়েছে বাংলাদেশের শিল্পমন্ত্রক। সেই ১৯৮৯ সালের পর থেকে ঐ ঢাকায় অবস্থিত জাতীয় সংস্থাটিই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য নানাবিধ পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়ন করে আসছে। ২০১২ সাল থেকে এই জাতীয় উৎপাদনশীলতা দিবস পালনের কথা ঘোষণা করার পাশাপশি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতি বছর দেশীয় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক বিভিন্ন শিল্পসংস্থা এবং উদ্যোগপতিদের উদ্দেশে ‘প্রোডাক্টিভিটি অ্যাণ্ড কোয়ালিটি পুরস্কার’ দানের কথাটিও ঘোষণা করেছেন। এই উৎপাদনশীলতার দিকে মনোনিবেশ করার ফলে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে ক্রমেই বাংলাদেশে বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে যা ভবিষ্যতে আরো বাড়ানোর লক্ষ্য স্থির করেছেন তিনি। এক্ষেত্রে একটা বিষয়ই প্রাধান্য দেওয়া জরুরি আর তা হল কর্তৃপক্ষ আর কর্মচারীদের মধ্যে সুসংহত সম্পর্ক যা একমাত্র কোনো সংস্থার উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়তা করবে। এখানেই এই দিনটি পালনের তাৎপর্য লুকিয়ে আছে।

প্রতিবারই শিল্পমন্ত্রকের অধীনে ‘ন্যাশনাল প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশন’ সমগ্র দেশ জুড়ে নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে জাতীয় উৎপাদনশীলতা দিবসকে কেন্দ্র করে। বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন রকমভাবে এই দিনটি উদযাপিত হয়। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, সভা-সমিতির পাশাপাশি এই দিনে প্রতিবারই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীর উদ্দেশে বিশেষ বক্তব্য রাখেন। বর্ণাঢ্য মিছিলে সমবেত হন বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার অধিকর্তা, কর্মী, কারখানার মালিক, শ্রমিক সহ আরো বহু উদ্যোগপতিরা। নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বিভিন্ন জায়গায় সেমিনার আয়োজিত হয়। মোবাইল ফোন অপারেটর সংস্থা এই দিনটিকে মনে রেখে দেশের সকল মানুষকে কিছু বার্তা পৌঁছে দেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে এই দিনের তাৎপর্য বিষয়ে নানা অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয় এবং সংবাদপত্রে এই দিনের গুরুত্বকে মনে রেখে বিশেষ সংখ্যা বা ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, এনপিও (NPO) সংস্থার চেয়্যারম্যান, বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠানের সিইও একত্রে বৈঠক করেন এই দিন যাতে আগামী দিনের পরিকল্পনা স্থির করা হয়।

২০১২ সালে প্রথম বাংলাদেশে পালিত হয় জাতীয় উৎপাদনশীলতা দিবস যেখানে প্রতিপাদ্য বা থিম ছিল ‘উপযোগী উৎপাদনের লক্ষ্যে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি’ (Improve Productivity for Efficient Production)। এরপরে প্রতি বছরই বিশেষ কিছু প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পালিত হয়েছে এই বিশেষ দিনটি। ২০১৬তে প্রতিপাদ্য ছিল ‘দীর্ঘস্থায়ী সমৃদ্ধির জন্য উৎপাদনশীলতা’ (Productivity for Sustainable Growth) এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পালিত হয়েছিল জাতীয় উৎপাদনশীলতা দিবস। এর পর ২০১৭ সালে ‘টেকসই উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির জন্য উৎপাদনশীলতা’ (Productivity for Sustainable Development and Growth) এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পালিত হয়েছিল জাতীয় উৎপাদনশীলতা দিবস। ২০১৮ সালে এই বিশেষ দিনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘আনন্দময় এবং সমৃদ্ধিশালী দেশের জন্য উৎপাদনশীলতার উন্নয়ন’ (Productivity Development for Happy and Prosperous Country)। ২০১৯ সালে জাতীয় উৎপাদনশীলতা দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘দীর্ঘস্থায়িত্ব এবং উৎপাদনশীলতার জন্য চক্রাকার অর্থনীতি’ (Circular Economy for Productivity & Sustainability)। এরপরে ২০২০ সালে ‘জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে উৎপাদনশীলতা’ (Productivity to Build Golden Bangladesh as Dreamt by Father of the Nation)। ২০২১ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় – অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় উৎপাদনশীলতা'(Productivity for Irresistible Advancement)। ২০২২ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় – “উৎপাদনশীলতার মাধ্যমে স্বনির্ভরতা” (Self-Reliance through Productivity)। ২০২৩ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় – “স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য উৎপাদনশীলতা” (Productivity for Smart Bangladesh)।

One comment

আপনার মতামত জানান