মুজফ্‌ফারপুর বোমা মামলা

মুজফ্‌ফারপুর বোমা মামলা

ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে গুপ্ত সমিতির বোমা বিস্ফোরণ ব্রিটিশ পুলিশ এবং বিচারব্যবস্থার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। গুপ্ত বিপ্লবী সমিতির গেরিলা আক্রমণে গোটা বাংলার মাটি যেন ল্যাণ্ড-মাইনে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশদের কাছে। আগ্নেয়াস্ত্র আমদানি আর বোমা তৈরির কৌশল শিখে অত্যাচারী, নৃশংস ব্রিটিশ পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটদের হত্যা করার গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বুনছিলেন সেসময়কার ‘অনুশীলন সমিতি’, ‘যুগান্তর সমিতি’র বিপ্লবীরা। আর বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই অনুশীলন সমিতির দুই বিপ্লবীর ম্যাজিস্ট্রেট-হত্যার চক্রান্তের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় মুজফ্‌ফারপুর বোমা মামলা (Muzaffarpur bomb case)। বাংলার মাটিতে সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাসে মুজফ্‌ফারপুর বোমা মামলা অন্যতম স্মরণীয়।

১৯০৮ সালের ২১ মে শুরু হয় মুজফ্‌ফারপুর বোমা মামলা যা ১৩ জুলাই পর্যন্ত টানা দুই মাস ধরে চলেছিল। অভিযুক্ত বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর বিরুদ্ধে রুজু হওয়া এই রাষ্ট্রোদ্রোহিতার মামলায় (মুজফ্‌ফারপুর বোমা মামলা ) রায় দিয়েছিলেন মুজফ্‌ফারপুরের অতিরিক্ত সেশন বিচারক এইচ. সি. ডব্লিউ কার্ণ্ডাফ এবং পরে বিচারক সি. ডব্লিউ ব্রেট, এ. ই. রিভস প্রমুখ এই রায়ে সম্মতি জানান। বলাই বাহুল্য ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যার চক্রান্তের বিরুদ্ধে ক্ষুদিরাম বসুর বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করে ব্রিটিশ সরকার।

১৮৬০-’৭০ সাল থেকেই ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন লক্ষ করা যায়, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় তা আরো চরমে ওঠে। স্বরাজের দাবিতে যখন গোটা দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল, সেসময় জারি হয় কুখ্যাত ‘কার্লাইল সার্কুলার’। সমস্ত রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ ও মতামত দমনের জন্য মরিয়া ওঠে ব্রিটিশ সরকার। তখন থেকেই বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠতে থাকে গুপ্ত সমিতিগুলি যাদের একটাই মূলমন্ত্র ছিল সশস্ত্র রক্তাক্ত বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন। মেদিনীপুরেও এভাবেই গড়ে ওঠে অনুশীলন সমিতি এবং কলকাতাতে এর শাখা স্থাপিত হয়। প্রমথনাথ মিত্র, সতীশ চন্দ্র বসু প্রমুখদের উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই অনুশীলন সমিতিতে পরে যোগ দেন অরবিন্দ ঘোষের ভাই বারীন ঘোষ সহ আরো অনেকে। পরে বারীন ঘোষ, অরবিন্দ ঘোষ, উপেন্দ্রেনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখরা মিলে আলাদা করে ‘যুগান্তর দল’ গড়ে তোলেন। হেমচন্দ্র কানুনগো ততদিনে ফ্রান্সে রাশিয়ান অ্যানার্কিস্ট নিকলাস সাফ্রান্সকির কাছ থেকে শিখে এসেছেন বোমা তৈরির কৌশল। ফলে বোমা মেরে ব্রিটিশ পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটদের হত্যা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীরা। আর তখন অনুশীলন সমিতির সঙ্গে পরোক্ষভাবে যুক্ত জাতীয়তাবাদী পত্র-পত্রিকাগুলি যেমন বন্দেমাতরম, সন্ধ্যা ইত্যাদি সরকার আইনপূর্বক নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। স্মস্ত বিপ্লবীর চোখের বালি তখন কলকাতার ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কিংসফোর্ড। স্বদেশি এবং বিপ্লবীদের উপর নির্বিচারে অত্যাচার করতেন কিংসফোর্ড। সুশীল সেন নামে এক বিপ্লবীকে ব্রিটিশ-বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার কারণে অত্যাচারের তাড়নায় প্রায় মেরেই ফেলেছিলেন এবং সুশীল সেনের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে বাংলার বিপ্লবীদের মনে তখন থেকেই কিংসফোর্ড হত্যার পরিকল্পনা দানা বাঁধতে থাকে। প্রথমে ১৯০৮ সালের জানুয়ারি মাসে হেমচন্দ্র দাস কানুনগো একটি বোমা বইয়ের মধ্যে পাতা কেটে এমনভাবে বসিয়ে কিংসফোর্ডের কাছে পাঠান যে বইটি খোলামাত্র বিস্ফোরণ অবশ্যম্ভাবী ছিল। হার্বার্ড ব্রমের লেখা ১০৭৫ পৃষ্ঠার সেই বইটির নাম ছিল ‘এ কমেন্টারি অন দ্য কমন ল’ ডিজাইন্ড অ্যাস ইন্ট্রোডাক্টরি টু ইটস স্টাডি’। বইটির আশি পাতা থেকে চারশো পৃষ্ঠার মধ্যে একটি বর্গাকার অংশ কেটে চকলেটের সঙ্গে পিকরিক অ্যাসিড মিশিয়ে একটা স্প্রিং দিয়ে আটকানো ছিল এমনভাবে যাতে বইটি খোলামাত্র বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু বইটি নিজে হাতে না খোলায় সে যাত্রায় রক্ষা পান কিংসফোর্ড এবং বইটি মুজফ্‌ফারপুরের মেডিকেল লাইব্রেরিতে রেখে আসার নির্দেশ দেন তিনি। পরে একথা জানতে পেরে ১৯০৯ সালে কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার ফ্রেডারিক লচ হ্যালিডে রাস্তার উপর এটি বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা করার সময় বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে বোমা বিস্ফোরণের পিছনে এক গভীর চক্রান্তের কথা জানতে পারে ব্রিটিশ পুলিশ। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত কলকাতা থেকে বদলি হয়ে তখন কিংসফোর্ড চলে যান বিহারের মুজফ্‌ফারপুরে। ঠিক এই সময়েই বারীন ঘোষের নির্দেশে বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী এবং অনুশীলন সমিতির সদস্য কিশোর ক্ষুদিরাম বসু কিংসফোর্ড হত্যায় লিপ্ত হন। অত্যাচারী শাসক কিংসফোর্ডকে হত্যার জন্য দুটি রিভলবার, একটি তাজা বোমা আর কিছু টাকা নিয়ে মুজফফারপুরে কিংসফোর্ডের কোয়ার্টারের কাছেই ছদ্মবেশে থাকতে শুরু করেন তাঁরা। তাঁরা লক্ষ করেছিলেন কিংসফোর্ডের কোয়ার্টারের কাছেই একটা ব্রিটিশ ক্লাব রয়েছে যেখানে শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গদের প্রবেশের অনুমতি ছিল। কোয়ার্টার থেকে প্রায়ই একটি ফিটন গাড়িতে চেপে কিংসফোর্ড ক্লাবে যেতেন। সেই মতো প্রফুল্ল চাকী এবং ক্ষুদিরাম বসু পরিকল্পনা করেন ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল তাঁরা ক্লাবে যাওয়ার পথেই কিংসফোর্ডকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত কিংসফোর্ড ভেবে ফিটন চেপে ক্লাবে আসা কেনেডি-দম্পতিকে বোমা মেরে হত্যা করেন তারা। ফিটনে আইনজীবী প্রিঙ্গলি কেনেডির স্ত্রী মিসেস গ্রেস কেনেডি ও তার কন্যাও ছিলেন। গুরুতরভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও সকলেরই মৃত্যু হয় অবশেষে। পরদিন সকালে পলায়নরত অবস্থাতেই ক্ষুদিরাম বসু জানতে পারেন যে কিংসফোর্ড জীবিত আছেন। বেশিদূর পালাতে পারেননি তিনি। ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্লকে ধরার জন্য ব্রিটিশ পুলিশ পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯০৮ সালের ১ মে সকাল আটটা নাগাদ মুজফ্‌ফারপুর থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে ওয়েনি স্টেশনে এক মুদির দোকানে স্থানীয় কয়েকজন লোক ক্ষুদিরাম বসুকে শনাক্ত করে পুলিশকে খবর দেয় আর সেখানেই কনস্টেবল ফতেহ সিং আর শিউ প্রসাদ সিং ক্ষুদিরাম বসুকে গ্রেপ্তার করে এবং তাঁকে তৎক্ষণাৎ মুজফ্‌ফারপুরের পুলিশ সুপারিনটেণ্ডেন্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্ষুদিরামের কাছে সেইসময় দুটি রিভলবার এবং সাঁইত্রিশ রাউণ্ড গুলি পাওয়া গিয়েছিল। ডিস্ট্রিক্ট পুলিশ সুপারিনটেণ্ডেন্টের কাছে ক্ষুদিরাম বসু স্বীকার করেন যে তিনি বোমা ছুঁড়েছিলেন এবং তাতে তিনজন নিরপরাধ ব্রিটিশ মারা গেছেন। ঐদিনই মোকামা ঘাট স্টেশনে পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর নন্দলাল ব্যানার্জি প্রফুল্ল চাকীকে গ্রেপ্তার করেন। কিন্তু প্রফুল্ল ধরা পড়ার আগেই পরপর দুটি গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। তাঁর মৃতদেহ মুজফ্‌ফারপুরে নিয়ে যাওয়া হয় শনাক্তকরণের জন্য। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ক্ষুদিরাম বসুকে সেই মৃতদেহ দেখানো হলে ক্ষুদিরাম তাঁকে নিজের সহকারী বন্ধু হিসেবে শনাক্ত করতে অসম্মত হন এবং জানান যে সেই ব্যক্তি আসলে দীনেশচন্দ্র রায়। এতে স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ পুলিশের প্রত্যয় হয়নি। মোট চব্বিশ জন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান নেওয়া হয় সত্য প্রমাণের জন্য। এই মামলার গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং এর সঙ্গে বাংলার বহু গুপ্ত বিপ্লবী সমিতির প্রত্যক্ষ যোগসূত্র আছে মনে করে ব্রিটিশ সরকার এই মামলায় বিচারের ভার ন্যস্ত করে তৎকালীন মুজফ্‌ফারপুরের অতিরিক্ত দায়রা বিচারপতি এইচ.ডব্লিউ.সি ক্যাণ্ডার্ফের উপর।

১৯০৮ সালের ২১ মে মামলা শুরু হলে ক্ষুদিরাম বসুর পক্ষে ওকালতি করার জন্য ছুটে আসেন কালিদাস বসু, উপেন্দ্রনাথ সেন, ক্ষেত্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পরে কুলকমল সেন, নগেন্দ্রলাল লাহিড়ীও বহু সহায়তা করেছেন ক্ষুদিরামকে মুক্ত করার জন্য। এমনকি এদের কেউই ওকালতি করার জন্য কোনোপ্রকার সম্মান-দক্ষিণা নেননি। কিন্তু ক্ষুদিরাম বসু আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনোপ্রকার চেষ্টাই করেননি। ১৯০৮ সালের ১৩ জুন বিচারপতি এইচ. ডব্লিউ. সি ক্যাণ্ডার্ফ ক্ষুদিরামের বিচারের চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যদণ্ডের সাজা ঘোষণা করেন। পরে উকিলদের পরামর্শে সাজা মকুবের আবেদন করেন ক্ষুদিরাম কিন্তু একপাক্ষিক বিচারের ফাঁদে কলকাতা হাইকোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট ই. ডব্লিউ. ব্রেডউড সেই আবেদন খারিজ করে দেন। বিচারপতি ক্যাণ্ডার্ফ ক্ষুদিরামের মুখে রায় শোনানোর পর হাসি লক্ষ করে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে তিনি কি এই রায়ের মর্ম বুঝতে পারেননি? উত্তরে ক্ষুদিরাম বসু বলেছিলেন দেশের জন্য মরতে তিনি ভয় পান না, কিন্তু তাঁর আক্ষেপ একটাই কিংসফোর্ডকে গুলি করে মারতে পারেননি তিনি, কিংসফোর্ড তখনও জীবিত। ফাঁসির আগে শেষ ইচ্ছে হিসেবে ক্ষুদিরাম চেয়েছিলেন মেদিনীপুর শহরটা একবার ঘুরে দেখতে এবং ঐ সময়েই তাঁর দিদি-ভাগ্নে-ভাগ্নিদের সঙ্গে একবার দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কোনো ইচ্ছাই মানা হয়নি। ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট কিশোর বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি হয়। মুজফ্‌ফারপুর বোমা মামলার সমাপ্তি ঘটে সেখানেই।

পরবর্তীকালে ক্ষুদিরামের ফাঁসিকে ঘিরে বাঁকুড়ার বিখ্যাত লোকগীতিকার পীতাম্বর দাস রচনা করেন সাড়া জাগানো দেশাত্মবোধক গান ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ যা ১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সুভাষচন্দ্র’ ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছিল। তবে অনেকে মনে করেন চারণকবি মুকুন্দ দাসের লেখা এই গানটি। আজও সমানভাবে এই গানটি জনপ্রিয় হয়ে আছে।

তথ্যসূত্র


  1. ‘Hanged for Their Patriotism’, R. K. Tandon, NBT, 2009, Pg- 62-66‘
  2. Centenary of Martyrdom of Four Militant Nationalists of Bengal’, Atis Dasgupta (Social Scientist), Vol. 38, No. 1/2 (Jan. - Feb., 2010), pg. 77-80
  3. https://civilaspirant.in/
  4. https://www.bongodorshon.com/
  5. https://muzaffarpur.nic.in/
  6. https://www.laughalaughi.com/

3 comments

আপনার মতামত জানান