মোহিনী একাদশী ব্রত

মোহিনী একাদশী ব্রত

প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে মোহিনী একাদশী ব্রত পালন করা হয়। হিন্দুধর্মের মানুষেরা বিশ্বাস করেন, এই তিথিতে ভগবান বিষ্ণুর পুজো করলে মানুষ তার জীবনের সমস্ত পাপ থেকে মুক্তি পায় ও মৃত্যুর পর স্বর্গে যেতে পারে। এছাড়া এই ব্রত করলে বিবাহ সংক্রান্ত বাধাও দূর হয়ে যায়।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, এই দিনটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভগবান বিষ্ণুর একটি নারী রূপের কথা। পুরাকালে দানবদের সঙ্গে বারবার যুদ্ধে হেরে গিয়ে দেবতারা ঠিক করলেন যে তাঁরা সমুদ্র মন্থন করবেন এবং সেখান থেকে উঠে আসা অমৃত পান করবেন। ফলে তাঁরা অমর হয়ে যাবেন ও অসুরেরা তাঁদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

কিন্তু সমুদ্র মন্থনের মতো বিরাট কাজ একা দেবতাদের শক্তিতে কুলালো না। তখন তাঁরা অসুরদের অমৃতের ভাগ দেবেন বলে কথা দিয়ে তাদেরকেও এই কাজে সাহায্য করতে অনুরোধ করলেন। দেবতা ও অসুরেরা মিলিত ভাবে সমুদ্রকে মন্থন করতে শুরু করলেন।      কিছুকাল পরে নানারকম বহুমূল্য জিনিস ও মণিরত্নের সঙ্গে চিকিৎসার দেবতা ধন্বন্তরী একটি কলসিতে অমৃত নিয়ে সমুদ্র থেকে উঠে এলেন। তাঁকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই অসুরেরা সেই কলসি ছিনিয়ে নিয়ে গেল। দেবতারা অনেক যুদ্ধ করেও অসুরদের কাছ থেকে অমৃত উদ্ধার করতে পারলেন না।

বিফল হয়ে দেবতারা ভগবান বিষ্ণুর কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বললেন। বিষ্ণু তখন দেবতাদের চিন্তা করতে বারণ করে নিজে এক অপরূপ সুন্দরী নারীর রূপ ধারণ করে অসুরদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর সেই মোহিনী মূর্তি দেখে অসুরদের মন গলে গেল। মোহিনীর অনুরোধ এড়াতে না পেরে অসুরেরা অমৃতের কলসিটি দেবতাদের হাতে তুলে দিল। সেই অমৃত পান করে দেবতারা অমর হলেন এবং খুব সহজেই যুদ্ধ করে অসুরদের হারিয়ে দিলেন।

বলা হয়, যে দিনে বিষ্ণু মোহিনী মূর্তি ধারণ করে দেবতাদের সাহায্য করেছিলেন, সেই দিনটি ছিল বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথি। সেই থেকে এই দিনটির নাম দেওয়া হয়েছে মোহিনী একাদশী। এই তিথিতে বিষ্ণুর পুজো করলে তিনি খুব সন্তুষ্ট হন এবং ভক্তকে চাহিদা মত ফল দান করেন। 

এই ব্রতের মাহাত্ম্যের উল্লেখ পাওয়া যায় কূর্মপুরাণে। সেখানে আছে, মহারাজ যুধিষ্ঠির একদিন শ্রীকৃষ্ণের কাছে বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথির মাহাত্ম্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলেন। শ্রীকৃষ্ণ তখন বললেন, নিজের স্ত্রী সীতাদেবীকে বনবাসে পাঠানোর পর শ্রীরামচন্দ্র স্ত্রীর বিরহে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। তখন তিনি তাঁর গুরু মহর্ষি বশিষ্ঠকে জিজ্ঞাসা করেন যে কোন ব্রত পালন করলে মানুষের জীবনের সব দুঃখ ও দুর্দশা দূর হয়ে যায় ও মানুষ শান্তি লাভ করে। এই প্রশ্নের উত্তরে বশিষ্ঠ বলেন যে, যদিও শ্রীরামচন্দ্রের নাম জপ করলেই মানুষের জীবনের সব দুঃখ দূর হয়ে যায়, তবুও বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথি, যা মোহিনী একাদশী নামে পরিচিত, তা পালন করলেও মানুষ পাপ ও দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে পারে।

এরপর মহর্ষি এই তিথির মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, অনেকদিন আগে সরস্বতী নদীর তীরে ভদ্রাবতী নামে এক মহানগর ছিল। সেখানে দ্যুতিমান নামে এক ধার্মিক ও প্রজাপরায়ণ রাজা রাজত্ব করতেন। ওই নগরীতে একজন ধনী বৈশ্য বাস করতেন। তাঁর নাম ছিল ধনপাল। তিনিও খুব ধার্মিক এবং বিষ্ণুভক্ত ছিলেন। নগরের বাসিন্দাদের সুবিধার জন্য তিনি অনেক অন্নসত্র, জলসত্র, কুয়ো, ফুলের বাগান, পুকুর, অতিথিশালা, মন্দির ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

এই ধনপালের পাঁচটি ছেলে ছিল। তাদের মধ্যে সবথেকে ছোট ছেলেটির নাম ছিল ধৃষ্টবুদ্ধি। সে ছিল তার বাবার সম্পূর্ণ বিপরীত প্রকৃতির। সে সবসময় খারাপ লোকেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করত। মদ্যপান, জীবহিংসা, অধর্মাচরণ, বেশ্যাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ইত্যাদি কাজেই ছিল তার আনন্দ। সে গুরুজন, ব্রাহ্মণ ও দেবতাদের একটুও ভক্তি করত না। তার বাবার কষ্ট করে আয় করা টাকাপয়সা দিয়ে সে এইসব জঘন্য কাজ করে বেড়াত। 

একদিন তার বাবা দেখতে পেলেন ধৃষ্টবুদ্ধি একটি সুন্দরী বেশ্যার গলা জড়িয়ে ধরে তাকে নিয়ে প্রকাশ্য রাজপথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে তার দুষ্ট বন্ধুরা এবং তারা রাস্তার লোকেদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অশ্লীল মন্তব্য করছে। এই দৃশ্য দেখে ধনপালের মন খুব খারাপ হয়ে গেল। তিনি ভীষণ রেগেও গেলেন। বাড়ি ফেরার পর তিনি ধৃষ্টবুদ্ধিকে রাস্তা থেকে ধরে আনালেন এবং তখনই তাকে ত্যাজ্যপুত্র করে দিলেন ও তার সব সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন।

বাবার সব সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে ধৃষ্টবুদ্ধি খুব কষ্টে দিন কাটাতে লাগল। তার কাছে টাকা না থাকায় তার সব বন্ধুরাও তাকে ছেড়ে চলে গেল। নগরের বেশ্যারাও আর তাকে ঘরে ঢুকতে দিল না। অনাহারে দিন কাটাতে কাটাতে সুদর্শন ধৃষ্টবুদ্ধি রোগা ও কুৎসিত হয়ে পড়ল।       খিদের জ্বালায় অস্থির হয়ে সে চুরি করতে শুরু করল। দু-একবার সফল হলেও অচিরেই সে নগরের প্রহরীদের হাতে ধরা পড়ল। কিন্তু তার বাবার কথা মনে করে প্রহরীরা তাকে ছেড়ে দিল। এইরকম ভাবে পরপর কয়েকবার ধরা পড়ার পর কিছু মূল্যবান জিনিস চুরির অপরাধে প্রহরীরা ধৃষ্টবুদ্ধিকে ধরে রাজা দ্যুতিমানের কাছে নিয়ে যায়। রাজাও ধনপালের কথা চিন্তা করে ধৃষ্টবুদ্ধিকে অন্য কোনো কঠিন সাজা না দিয়ে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিলেন।

রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে ধৃষ্টবুদ্ধির কষ্টের আর সীমা রইল না। খিদে সহ্য করতে না পেরে ব্যাধেদের মতো তীরধনুক নিয়ে সে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে লাগল এবং পশুপাখি শিকার করে কাঁচা মাংস খেতে লাগল।

এইভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর একদিন ধৃষ্টবুদ্ধি জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে মহর্ষি কৌণ্ডিন্যের আশ্রমে এসে উপস্থিত হল। খিদে তেষ্টায় খুব কাতর হয়ে সে আশ্রমের কাছে রাস্তার উপর শুয়ে রইল। সেই রাস্তা দিয়েই মহর্ষি কৌণ্ডিন্য গঙ্গায় স্নান করে ভিজে কাপড়ে আশ্রমে ফিরছিলেন। মহর্ষি ধৃষ্টবুদ্ধির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর কাপড় থেকে একফোঁটা গঙ্গার জল এসে ধৃষ্টবুদ্ধির শরীরে পড়ল। মহাত্মার শরীর থেকে পড়া গঙ্গার পবিত্র জলের স্পর্শ পেয়ে ধৃষ্টবুদ্ধির সব পাপ দূরে চলে গেল। তার খিদে তেষ্টাও মিটে গেল। সুস্থ হয়ে ধৃষ্টবুদ্ধি উঠে বসল ও সামনে মহর্ষি কৌণ্ডিন্যকে দেখে তাঁকে প্রণাম করল। কৌণ্ডিন্য তাকে আশীর্বাদ করে তার এই অবস্থার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। ধৃষ্টবুদ্ধি তখন অনুশোচনায় কাতর হয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিজের সব পাপে কথা স্বীকার করল এবং ঋষির পা ধরে এই পাপ থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায়ের কথা জানতে চাইল। তার অবস্থা দেখে মহর্ষির দয়া হল। তখন তিনি ধৃষ্টবুদ্ধিকে বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথি অর্থাৎ মোহিনী একাদশী তিথির কথা বললেন। তিনি আরও বললেন, এই তিথিতে উপোস করে যথা নিয়মে ভগবান বিষ্ণুর পুজো করলে মানুষ তার জীবনের সবরকম পাপ থেকে মুক্তি পেতে পারে। 

কৌণ্ডিন্যের কথা শুনে ধৃষ্টবুদ্ধি নির্দিষ্ট দিনে ভক্তিভরে একাদশী তিথি পালন করল ও ভগবান বিষ্ণুর কাছে পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রার্থনা করল। কিছুকাল পরে তার মৃত্যু হলে সে সব পাপ থেকে মুক্তি পেল এবং দিব্য রূপ ধারণ করে বিষ্ণুলোকে গিয়ে বাস করতে লাগল।  এই পর্যন্ত বলে মহর্ষি বশিষ্ঠ রামচন্দ্রকে বললেন যে যদি তিনি এই ব্রত পালন করেন, তবে তিনিও ধৃষ্টবুদ্ধির মতোই সব পাপ থেকে উদ্ধার পাবেন এবং তাঁর সকল দুঃখ দূর হবে।

এইভাবে মোহিনী একাদশী ব্রত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

আপনার মতামত জানান