মারিয়াপ্পান থাঙ্গাভেল্লু

মারিয়াপ্পান থাঙ্গাভেল্লু

ডান পা সম্পূর্ণভাবে অক্ষম হওয়ার পরেও ২০১৬ সালের রিও ডি জেনিরোর গ্রীষ্মকালীন প্যারালিম্পিকে ভারতের হয়ে অংশগ্রহণ করে সোনা জিতেছিলেন মারিয়াপ্পান থাঙ্গাভেল্লু (Mariyappan Thangavelu)। ২০০৪ সাল থেকে প্যারালিম্পিক হাই-জাম্পার হিসেবে শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও পুরুষদের টি-৪২ বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি স্বর্ণপদক জয়ের শিরোপা অর্জন করেছিলেন। ২০১৭ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি এবং ঐ একই বছর অর্জুন পুরস্কারেও সম্মানিত হন মারিয়াপ্পান। ২০২০ সালে ভারত সরকার তাঁকে মেজর ধ্যানচাঁদ খেলরত্ন পুরস্কারে ভূষিত করে যা ভারতের ক্রীড়াজগতে সর্বোচ্চ সম্মান।

১৯৯৫ সালের ২৮ জুন তামিলনাড়ুর সালেম জেলার পেরিয়াভারাগামপট্টি গ্রামে অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে মারিয়াপ্পান থাঙ্গাভেল্লু র জন্ম হয়। তাঁর বাবা অনেক আগেই পরিবারকে ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে তাঁর মা সরোজা একা হাতে ছয় সন্তানকে বড়ো করে তুলেছেন। কখনো শ্রমিক হিসেবে ইঁট বহনের কাজ, কখনো আবার সবজি বিক্রি করে দিনে একশো টাকা উপার্জন করে চার পুত্র ও এক কন্যার মুখে অন্ন জুগিয়েছেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে স্কুলে যাওয়ার পথে এক মদ্যপ বাস চালক উন্মত্ত গতিতে বাস চালিয়ে চাকার নীচে পিষে দেয় তাঁর ডান পা যার ফলে চিরস্থায়ীভাবে ঐ একটা পা তাঁর অক্ষম হয়ে যায়। পঙ্গু হয়ে পড়েন মারিয়াপ্পান। কিন্তু তা সত্ত্বেও মনোবল ভাঙেনি তাঁর। নিজেকে ছোটো থেকেই কখনো অক্ষম ভাবেননি তিনি, অন্যান্য স্বাভাবিক ছেলে-মেয়েদের মতো তিনিও যে সব কিছুই করতে পারেন এই মনোভাব পোষণ করেন মারিয়াপ্পান। তাঁর চিকিৎসার জন্য তিন লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তাঁর মা সরোজা। কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস, চিকিৎসাতেও সুস্থ হতে পারেননি মারিয়াপ্পান, একটা পা তাঁর চিরকালের জন্য পঙ্গু হয়েই রইলো। আর তাঁর পরিবারকে সেই থেকেই এখনও পর্যন্ত ঋণ শোধ করে যেতে হচ্ছে।

শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও পড়াশোনা ছাড়েননি মারিয়াপ্পান থাঙ্গাভেল্লু । স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের পড়া শেষ করে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন তিনি। তারপরে এভিএস কলেজ অফ আর্টস অ্যাণ্ড সায়েন্সে বাণিজ্য প্রশাসন বিষয়ে স্নাতক স্তরে ভর্তি হন মারিয়াপ্পান। উচ্চশিক্ষার পথে আরো এগিয়ে যেতে চেয়েছেন তিনি, চেয়েছেন এমবিএ করতে। অক্ষমতা সঙ্গে নিয়েও তাঁর মনোবল একটুও ক্ষুণ্ন হয়নি। স্কুলে পড়াকালীনই ভলিবল খেলতে চাইতেন মারিয়াপ্পান। কিন্তু তাঁর পক্ষে এই অক্ষমতা নিয়ে ভলিবল খেলা সম্ভব ছিল না। কিন্তু তাঁর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকই প্রথম তাঁকে হাই-জাম্পে আগ্রহী করে তোলেন এবং হাই-জাম্পকে বেছে নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। ২০১৩ সালের জাতীয় প্যারালিম্পিক চ্যাম্পিয়নশিপে প্রশিক্ষক সত্যনারায়ণের চোখে পড়েন তিনি আর তারপরই জীবনটা বদলে যায় মারিয়াপ্পানের। সত্যনারায়ণ তাঁকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোরের ‘স্পোর্টস অ্যাকাডেমি অফ ইণ্ডিয়া সেন্টার ফর ডিফারেন্টলি-এব্‌লড’ সংস্থায় চলে আসেন সঠিকভাবে তাঁকে প্রশিক্ষিত করার জন্য। এখানেই মারিয়াপ্পান তাঁর দক্ষতা বাড়ানোর এবং বিশেষ বিশেষ কৌশল শেখার সুযোগ পান। মাত্র দেড় বছরের প্রশিক্ষণেই ২০১৫ সালে তিনি বিশ্বসেরা অ্যাথলিটের মর্যাদা পান। প্রথমে জাতীয় স্তরে এবং তারপরে আন্তর্জাতিক স্তরে দক্ষতা প্রদর্শন করতে থাকেন মারিয়াপ্পান। এভাবেই শিক্ষাজীবন থেকে ক্রীড়াচর্চাকেই কর্মজীবনের অঙ্গীভূত করে নেন তিনি।

প্রতিযোগিতায় জিতে সেই পুরস্কারমুল্য দিয়ে তাঁর মায়ের জন্য একটি ধানজমি কিনেছেন মারিয়াপ্পান যা তাঁর পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। ২০১৬ সালে প্রথমে তিউনিশিয়ার আইপিসি গ্র্যাণ্ড প্রিক্সে পুরুষদের হাই জাম্পে টি-৪২ বিভাগে ১.৭৮ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করে তাক লাগিয়ে দেন বিশ্বকে। এই প্রতিযোগিতায় সাফল্যের ফলেই রিও ডি জেনিরোর প্যারালিম্পিকে যোগদানের পথ সহজ হয়ে যায় তাঁর কাছে। ২০১৬ সালের গ্রীষ্মকালীন প্যারালিম্পিকে ইতিহাস গড়ে তোলেন মারিয়াপ্পান। পুরুষদের হাই জাম্পে টি-৪২ বিভাগে ১.৮৯ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করে স্বর্ণপদক জয় করেন ভারতের গর্ব মারিয়াপ্পান থাঙ্গাভেলু। ঐ প্রতিযোগিতায় মারিয়াপ্পানের সঙ্গে আরেক ভারতীয় বরুণ ভাতি রৌপ্য পদক জয় করেছিলেন ১.৮৬ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করে আর ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন মার্কিন অ্যাথলিট স্যাম গ্রিউয়ি। মারিয়াপ্পানই সর্বপ্রথম প্যারালিম্পিকে হাইজাম্পে স্বর্ণপদক লাভ করেন। যদিও তথ্যের ভিত্তিতে মারিয়াপ্পান ছিলেন প্যারালিম্পিকে স্বর্ণপদকজয়ী তৃতীয় ভারতীয়, তাঁর আগে ১৯৭২ সালে সাঁতারু মুরলীকান্ত পেটার এবং ২০০৪ সালে জ্যাভলিন নিক্ষেপক দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন। বিশ্বের দরবারে ভারতের গর্বের মুকুটে নতুন পালক এনে দেন মারিয়াপ্পান। এই জয়, এই অভূতপূর্ব সাফল্য মারিয়াপ্পানের স্বপ্নপূরণ করেছিল। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন তরফ থেকে অর্থসাহায্য আসতে থাকে। তামিলনাড়ু স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের বহু গুণীজন তাঁকে অভিনন্দন জানাতে আসেন, সরকারি-বেসরকারি উভয়পক্ষ থেকেই অর্থকরী সহায়তা পান মারিয়াপ্পান যা তাঁর পরিবারকে এতদিন পরে আর্থিক নিরাপত্তা এনে দেয়। তাঁর দুই ভাই কুমার ও গোপি এবং এক বোন সুধা আর তাঁর মাকে নিশ্চয়তা দিয়েছে এই পুরস্কারের অর্থমূল্য। রিও অলিম্পিকের পরে ২০১৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে মারিয়াপ্পান জানান এই সাফল্যের কারণে তাঁর প্রতিবেশিরা তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে যথেষ্ট সমীহ করেন, ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন, এমনকি তাঁর আগের বন্ধুরা তাঁর প্রতি অনাবশ্যক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন যা একেবারেই পছন্দ করেন না তিনি। পুরস্কারের অর্থমূল্যে সংসার চালাতে হয়েছে তাঁকে, তাই তামিলনাড়ুর সরকারের কাছে একটি নিশ্চিত নিরাপদ এবং বাঁধা বেতনের চাকরির আবেদন জানিয়েছিলেন মারিয়াপ্পান। কিন্তু তার কোনো সদুত্তর তিনি পাননি। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে জাকার্তায় ২০১৮ এশিয়ান প্যারা গেমসে পতাকাবাহক হিসেবে নির্বাচিত হন মারিয়াপ্পান। ঐ বছরই ৭ ডিসেম্বর ভারত সরকারের ক্রীড়া মন্ত্রকের গ্রুপ-এ পদে একজন প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার প্রস্তাব পান তিনি। পরবর্তীকালে ২০১৯ সালের ওয়ার্ল্ড প্যারা অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে পুরুষদের হাইজাম্পে টি-৬৩ বিভাগে ১.৮০ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করে ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেন। অপর এক ভারতীয় অ্যাথলিট শরদ কুমারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি সেবারে স্বর্ণপদক পেতে ব্যর্থ হন। ২০২০ সালে টোকিও প্যারালিম্পিকে ৫৪ জন ভারতীয় অ্যাথলিটের দলের হয়ে মার্চ পাস্টে পতাকাবাহক হওয়ার কথা ছিল মারিয়াপ্পান থাঙ্গাভেলুর। প্যারালিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পাঁচ জন ভারতীয় অ্যাথলিটকে অলিম্পিক কমিটি থেকে নিষেধ করে দেওয়া হয় কারণ জানা গিয়েছিল তাঁরা সদ্যই করোনা-আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছিলেন। ফলে টোকিও প্যারালিম্পিকে মারিয়াপ্পানের পরিবর্তে পতাকাবহন করেন ভারতীয় জ্যাভলিন নিক্ষেপক তেক চাঁদ।

রিও অলিম্পিকে তাঁর অভূতপূর্ব সাফল্যের পরে শচীন তেণ্ডুলকর মুগ্ধ হয়ে তাঁর জন্য ১৫ লক্ষ টাকার একটি তহবিল গড়ে তোলেন। এমনকি এর পরে ভারত সরকারের ক্রীড়া মন্ত্রক ৭৫ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেয় মারিয়াপ্পানকে এবং তৎকালীন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা ২ কোটি টাকা পুরস্কার দেন তাঁকে। শুধু তাই নয়, এরপর যথাক্রমে মধ্যপ্রদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা, যশ রাজ ফিল্মসের পক্ষ থেকে স্বত্বপিছু ১০ লক্ষ টাকা এবং দিল্লি গল্‌ফ ক্লাবের পক্ষ থেকে ১০ লক্ষ টাকা লাভ করেন মারিয়াপ্পান। বর্তমানে দক্ষিণ ভারতীয় বিখ্যাত অভিনেতা ঐশ্বর্য রজনীকান্ত ধানুশের প্রযোজনায় মারিয়াপ্পান থাঙ্গাভেল্লু কে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মীয়মাণ। সম্প্রতি একটি খুনের মামলার সঙ্গে জুড়ে গেছে মারিয়াপ্পানের নাম। মাদ্রাজ হাইকোর্টে এক মহিলা মামলা দায়ের করেছেন এই মর্মে যে তাঁর উনিশ বছর বয়সী পুত্র সতীশ কুমারকে হত্যা করেছেন স্বর্ণপদকজয়ী অ্যাথলিট মারিয়াপ্পান। তাঁরই বয়ান থেকে জানা যায় যে, মারিয়াপ্পানের বাইকে ধাক্কা মারার জন্য মারিয়াপ্পান এবং তাঁর দুই বন্ধু শবরী ও যুবরাজ সতীশকে প্রচণ্ড প্রহার করে। যখন তারা সতীশের মোবাইল ছিনিয়ে নেয়, তখন তাঁদের পিছু ধাওয়া করে সতীশ। সেই থেকে সারা রাত সতীশ নিখোঁজ ছিল। পরদিন সকালে রেললাইনের ধারে সতীশের মৃতদেহ আবিষ্কার করে পুলিশ। উনিশ বছর বয়সী একটি ছেলের মৃত্যুতে তোলপাড় হয়ে উঠেছে ভারতীয় আদালত আর এর সঙ্গে যখন জড়িয়ে পড়েছে ভারতের গর্ব পদকজয়ী অ্যাথলিটের নাম তখন বিষয়টি বেশ গুরুতর হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য মারিয়াপ্পানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই পুলিশ ক্ষান্ত থাকে।

২০১৭ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের চতুর্থ শ্রেষ্ঠ নাগরিক সম্মান পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত হন মারিয়াপ্পান থাঙ্গাভেলু এবং ঐ বছরই একইসঙ্গে অর্জুন পুরস্কারেও সম্মানিত হন তিনি। পরে ২০২০ সালে রাজীব গান্ধী খেলরত্ন (অধুনা মেজর ধ্যানচাঁদ খেলরত্ন) পুরস্কার লাভ করেন তিনি।

২০২১ সালে আয়োজিত টোকিও প্যারালিম্পিকে তিনি পুরুষদের হাই জাম্প T63 ইভেন্টের ফাইনালে ১.৮৮ মিটার উচ্চতা স্পর্শ করে রুপো জয় করেন।

আপনার মতামত জানান