ইসমত চুঘতাই

ইসমত চুঘতাই

ভারতের একজন বিখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক এবং ছোটগল্পকার ইসমত চুঘতাই (Ismat Chughtai)। তাঁর গল্পে বারবার উঠে এসেছে মধ্যবিত্ত সমাজের ভ্রান্ত নীতি-আদর্শ এবং মূল্যবোধের বিপর্যয়। একইসঙ্গে সমাজে মেয়েদের যৌনতা এবং যৌনচেতনার নানা দিক যেমন তাঁর লেখায় স্থান পেয়েছে, তেমনি নারীবাদের প্রচ্ছন্ন প্রভাবও লক্ষ করা যায় তাঁর লেখায়। জাত-পাত, বর্ণবৈষম্যের ক্লিন্ন চিত্র ইসমত তুলে ধরেন তাঁর লেখনীতে। উর্দু সাহিত্যের দিকপাল লেখক সাদাত হাসান মান্টোর সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে সাহিত্যের দুনিয়াতেও তাঁদের নাম একত্রে উচ্চারিত হয়। লাহোরের একটি লিটল ম্যাগাজিন ‘আদাব-ই-লতিফ’-এ ইসমত চুঘতাইয়ের লেখা ‘লিহাফ’ গল্পটি ছাপা হলে অশ্লীলতার দায়ে লেখাটি নিন্দিত হয় এবং ১৯৪২ সালে প্রকাশিত এই লেখায় প্রথম উঠে আসা নারীর সমকামিতা তৎকালীন সমাজে তথা দেশে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। নারীর চাহিদা ও চেতনা, নারীর অধিকার এবং নারীর অপমান ও অবহেলার কথাই সচেতনভাবে ইসমত তাঁর লেখায় স্থান দেন। তাঁর লেখা ‘টেড়ি লাকির’ উপন্যাসটি উর্দু সাহিত্যের এক সম্পদ বলা যায়। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনে মুসলিমরা কীভাবে বাস করত তার এক নিবিড় ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি এই উপন্যাসে। সমালোচকেরা তাঁর লেখা মার্ক্সীয় চেতনা এবং সাহিত্যিক বাস্তববাদের ছায়া লক্ষ্য করেছেন। বিশ শতকের উর্দু সাহিত্যের এক পথিকৃৎ ছিলেন ইসমত চুঘতাই। ১৯৭৬ সালে ভারত সরকার তাঁর কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে।

১৯১৫ সালের ২১ আগস্ট উত্তর প্রদেশের বাদায়ুনে ইসমত চুঘতাই য়ের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম মির্জা কাশিম বেগ চুঘতাই এবং মায়ের নাম নুসরত খানাম। তাঁর আরো ছয় ভাই এবং তিন বোন ছিল। মির্জা কাশিম এবং নুসরাতের দশ সন্তানের মধ্যে ইসমত ছিলেন নবম সন্তান। মির্জা কাশিম পেশায় একজন সিভিল সার্ভেন্ট হওয়ায় চাকরিসূত্রে বহুবার স্থান বদল করতে হয়েছে তাঁকে। যোধপুর, আগ্রা, আলিগড় প্রভৃতি নানা শহরে তাঁর শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলি কেটেছে। ইসমতের কৈশোরেই তাঁর সব বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে ইসমত স্বীকার করেছেন যে তাঁর মানসিকতায় ভাইদের এক বিরাট প্রভাব কাজ করেছিল। তাঁর দাদা মির্জা আজিম বেগ চুঘতাইকে নিজের প্রশিক্ষক হিসেবে বর্ণনা করেছেন ইসমত। মির্জা আজিম বেগ নিজেও একজন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ছিলেন। ইসমতের বাবা চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে তাঁদের পরিবার আগ্রায় থিতু হয়।

আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওমেন্স কলেজে ইসমত চুঘতাই য়ের প্রাথমিক পড়াশোনা সম্পন্ন হয়। ১৯৪০ সালে ইসাবেলা থবার্ন কলেজ থেকে কলাবিদ্যায় স্নাতক উত্তীর্ণ হন তিনি। পরিবারের বাধা সত্ত্বেও ঐ বছরই তিনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এই সময়েই ইসমত প্রগতিশীল লেখক শিল্পী সংঘের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩৬ সালে এই সঙ্ঘের প্রথম সম্মেলনে উপস্থিত থেকে ইসমত অন্য এক প্রগতিশীল লেখিকা রশিদ জাহানের সঙ্গে দেখা করেন। রশিদ জাহানই পরবর্তীকালে বাস্তবসম্মত নারী চরিত্র সৃষ্টিতে প্রভাবিত করেছিলেন তাঁকে। এই সময় থেকেই ইসমত লিখতে শুরু করেন, কিন্ত তখনও কোনো প্রকাশককে তিনি তাঁর বই ছাপার প্রস্তাব দেননি। ১৯৩৯ সালে একটি উর্দু পত্রিকা ‘সাকি’র জন্য প্রথম ‘ফাসাদি’ নামে একটি উর্দু নাটক লেখেন তিনি। এই নাটকটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম। নাটকটি প্রকাশের পরে পাঠকরা ভেবেছিলেন যে এটি আসলে ইসমতের দাদা মির্জা আজিম বেগের ছদ্মনামে লেখা। সেই সময় থেকে অন্যান্য পত্র-পত্রিকাতে লিখতে শুরু করেন তিনি। ইসমতের প্রথমদিককার কিছু লেখার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল একটি আত্মজৈবনিক গদ্য ‘বচ্‌পন’, তাঁর লেখা প্রথম ছোটগল্প ‘কাফির’ এবং তাঁর লেখা একমাত্র স্বগতোক্তি ‘ধিত’। একটি পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখা দেখে কয়েকজন মন্তব্য করেছিল যে ইসমত তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরনিন্দা করছেন এবং তাঁর গল্প সবই কোরান বিরোধী। এই সব কথায়, সমালোচনায় পাত্তা না দিয়ে লেখা চালিয়ে যান তিনি। প্রগতিশীল লেখক শিল্পী সংঘের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তাঁর লেখায় বিশেষ একটি গড়ন তৈরি হতে থাকে। এই সংঘের মতাদর্শ ইসমতের লেখাকে প্রভাবিত করতে থাকে। ‘অঙ্গারে’ নামের একটি ছোটগল্পের সংকলন পড়ে ইসমত প্রভূত প্রভাবিত হন যেখানে ঐ সংঘের রশিদ জাহান, সাজ্জাদ জাহির, সাহিবজাদা মাহমুদ জাফার, আহমেদ আলি প্রমুখদের লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। তাছাড়া বিদেশি লেখকদের মধ্যে উইলিয়াম সিডনি পোর্টার, আন্তন চেকভ, জর্জ বার্নার্ড শ প্রমুখদের লেখাও তাঁকে প্রভাবিত করেছিল গভীরভাবে। ১৯৪১ এবং ১৯৪২ সালে ক্রমান্বয়ে ইসমত চুঘতাইয়ের দুটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয় ‘কল্যাণ’ এবং ‘কতেন’ নামে। ইসমতের লেখা প্রথম অণু-উপন্যাস ‘জিদ্দি’ ১৯৪১ সালে প্রকাশ পায়, যদিও এটি তিনি কুড়ি-বাইশ বছর বয়সেই লিখে ফেলেছিলেন। এই লেখার কাহিনী কেন্দ্রীভূত হয়েছিল এক সম্ভ্রান্ত বাড়ির ছেলের সঙ্গে সেই বাড়ির কাজের লোকের প্রেম-পরিণয়কে ঘিরে। সেকালের বিখ্যাত উর্দু ঔপন্যাসিক হিজাব ইমতিয়াজ আলির লেখার প্রভাব পড়েছিল ইসমতের এই লেখায়, তা তিনি নিজে স্বীকারও করেছিলেন। অনেক পরে ২০১৫ সালে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার এবং সমালোচক আমীর হুসেন ইসমত চুঘতাইয়ের লেখার শৈলীর সঙ্গে আমেরিকান লেখক টনি মরিসনের শৈলীর সাদৃশ্যের কথা বলেন। পরে এই ‘জিদ্দি’ উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হয় ‘ওয়াইল্ড অ্যাট হার্ট’ নামে এবং এই কাহিনী অবলম্বনে ১৯৪৮ সালে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়।

আলিগড়ের একটি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষিকা পদে বেশ কিছুদিন কাজ করেন ইসমত। এই সময় তাঁর লেখা দুটি ছোটগল্প ‘গাইন্দা’ এবং ‘খিদমতগার’ ও ‘ইন্তিখাব’ নামে একটি নাটক প্রকাশিত হয়। ১৯৪২ সালে তিনি বম্বেতে চলে আসেন এবং একজন স্কুল ইন্সপেক্টর হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। আলিগড়ে যে শহীদ লতিফের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁর, ইসমত বম্বেতে কাজ করার সময় তাঁকেই বিয়ে করেন। লতিফ সেই সময় বম্বের চলচ্চিত্র দুনিয়ায় চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজ করছিলেন। তাঁদের বিবাহের আইনি প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন খাজা আহমেদ আব্বাস। ১৯৪২ সালে লাহোরের একটি লিটল ম্যাগাজিন ‘আদাব-ই-লতিফ’-এ ইসমত চুঘতাইয়ের একটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয় ‘লিহাফ’ নামে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশ জুড়ে আলোড়ন ওঠে। অশ্লীলতার দায়ে তাঁর নামে মামলা করা হয় আদালতে। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী ভারতে প্রথম নারীর সমকামিতা বিষয়ে কথা বলা এবং গল্প লেখার অপরাধে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। সমগ্র দেশ জুড়ে নিন্দা আর কটু সমালোচনার ঝড় ওঠে। লাহোর আদালতে অশ্লীলতার অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় ইসমত চুঘতাইকে। ঠিক একই অভিযোগ করা হয়েছিল সাদাত হাসান মান্টোর বিরুদ্ধেও। ১৯৪৫ সালে হওয়া এই মামলায় প্রগতিশীল লেখক শিল্পী সংঘের অন্যান্য বেশ কিছু সদস্য মজনু গোরখপুরী, কৃষ্ণ চন্দরের সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে অবশেষে খালাস পান ইসমত চুঘতাই। তিনি তাঁর আত্মজীবনী ‘ইসমত : হার লাইফ, হার টাইমস’ বইতে এই ‘লিহাফ’ গল্পে বর্ণিত বেগম জানের সঙ্গে সত্যিকারের সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। ইসমত বলেছেন যে এই কাহিনী সত্য ঘটনা দ্বারা অনুপ্রাণিত, নচেৎ তাঁর পক্ষে এই গল্প লেখা সম্ভব হত না। ১৯৪৩ সালে তাঁর লেখা আরেকটি প্রায় আত্মজৈবনিক গদ্য ‘টেড়ি লকির’ প্রকাশিত হয়। এই সময় ইসমত গর্ভবতী ছিলেন, উপন্যাসটি প্রকাশের কয়েকদিন পরেই তাঁর এক কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনে মুসলিমরা কীভাবে বাস করত তার এক নিবিড় ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি এই উপন্যাসে।

১৯৪০ সালের শেষ দিকে শহীদ লতিফের উৎসাহে বম্বেতে চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেন ইসমত। তাঁর কাহিনী অবলম্বন করেই ১৯৪৮ সালে ‘জিদ্দি’ নামের একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায় যেখানে দেব আনন্দ প্রথম মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন এবং ছবিটি প্রভূত বাণিজ্যিক সফলতা অর্জন করে। এরপরে ১৯৫০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আরজু’ ছবির চিত্রনাট্য লেখেন তিনি। ১৯৫৩ সালে ‘ফরেব’ নামে একটি ছবি পরিচালনাও করেন ইসমত চুঘতাই। ‘আরজু’ এবং ‘ফরেব’ দুটি ছবিই দর্শক-আনুকূল্য পেয়েছিল। এরপর লতিফ এবং ইসমত একত্র একটি প্রোডাকশান হাউজ খোলেন যেখান থেকে ১৯৫৮ সালে প্রথম একটি ছবি মুক্তি পায় ‘সোনে কি চিড়িয়া’ নামে। ১৯৫২ সালে তাঁর চতুর্থ গল্প সংকলন ‘ছুই মুই’ প্রকাশ পায়। ১৯৬০ সালের শুরুর দিকে ৮টি উপন্যাস লেখেন ইসমত চুঘতাই যার মধ্যে প্রথম উপন্যাস ‘মাসুম’ প্রকাশ পায় ১৯৬২ সালে। ১৯৬৬ সালে প্রকাশ পায় তাঁর আরেকটি উপন্যাস ‘সওদাই’। তাঁর পঞ্চম উপন্যাস ‘দিল কি দুনিয়া’র জন্য ইসমত প্রভূত প্রশংসিত হন। ১৯৭০ সালে হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি লেখেন দুটি উপন্যাস – ‘জংলি কবুতর’ এবং ‘আজীব আদমি’।

১৯৭৪ সালে তাঁর আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘টেড়ি লকির’-এর জন্য গালিব পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ১৯৭৬ সালে ভারত সরকার ইসমত চুঘতাইকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে। এছাড়াও ১৯৭৯ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ উর্দু আকাদেমি অ্যাওয়ার্ড, ১৯৮২তে সোভিয়েত ল্যাণ্ড নেহেরু অ্যাওয়ার্ড এবং ১৯৯০ সালে রাজস্থান উর্দু আকাদেমি অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন তিনি।

১৯৯১ সালের ২৪ অক্টোবর মুম্বাইতে নিজের বাড়িতেই ইসমত চুঘতাইয়ের মৃত্যু হয়।    

2 comments

আপনার মতামত জানান