কলকাতা নাম হল কিভাবে

কলকাতা নাম হল কীভাবে

সুতানুটী, গোবিন্দপুর, কলিকাতা এই তিন গ্রাম নিয়ে কলিকাতা শহরের পত্তন হয়েছিল একথা আমাদের সকলেরই জানা, আর কলিকাতা থেকে আজকের কলকাতা সেই তথ্যও কারোর অজানা নয় কিন্তু সেই গ্রামটির কলিকাতা বা কলকাতা নাম হল কীভাবে তা নিয়ে কিন্তু অনেকেরই সঠিক জানা নেই।

কলকাতা নাম হল কীভাবে, দেখুন ভিডিওতে

কলকাতা নাম হওয়ার পিছনে সবচেয়ে প্রচলিত যে গল্প সেটি হল – এক সাহেবের ঐ জায়গার নাম জানতে ইচ্ছে হয়। কাছাকাছি কাওকে না পেয়ে, তিনি এক হিন্দুস্থানী কৃষককে জায়গার নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন। ভাষাগত সমস্যার জন্যে সেই কৃষক বুঝতে পারেনি তাকে কি জিজ্ঞেস করা হয়েছে, সে ধরে নেয় তাকে ঘাসগুলি কবে কাটা হয়েছে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে। সে উত্তর দেয় ‘কল কাটা’ অর্থাৎ গতকাল কেটেছে। সাহেব তাঁর উচ্চারণে একে ‘ক্যালকাটা’ বানিয়ে ফেললেন।

এটি নিতান্তই গল্প এবং এর কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। বরং আমরা চোখ রাখব আরও কয়েকটি প্রচলিত মতবাদের উপর।

১। অনেকের মতে ‘কালীঘাট’ থেকে কলিকাতা নামের উৎপত্তি হয়েছে। ভাষাতত্বে বিকারেরও একটা নির্দিষ্ট রীতি রয়েছে – আর সেই হিসেবে কালীঘাট থেকে কলিকাতা কোনও ভাবেই আসতে পারে না। এরই আরেকটি অন্য তত্ব হল, কালীকোঠা বা কালীকোট্টা (কালীর কোঠা বা ঘর) থেকে সাহেবি বিকৃতি থেকে কলিকাতার উৎপত্তি। একই দেবীর নামে দুটি নামের একটি কালীঘাট অবিকৃত রইল, অন্যটি পালটে গেল এটাও হয় না। আর সাহেবদের মুখে বিকৃত হওয়ার অনেক আগে থেকেই কলিকাতা নাম প্রচলিত ছিল।

২।আরেকটি প্রচলিত মত, ‘কালীক্ষেত্র’ থেকে কলিকাতা। কিন্তু এটাও ঠিক নয়, কালীর ক্ষেত্র বা তীর্থ হলেও কালীক্ষেত্র এর অপভ্রংশ কলিকাতা হতে পারে না। এও আগের কারণটির মতোই ভূল।

৩। ‘কিল্‌কিল’ থেকে কলিকাতা অনেকে বলে থাকেন কিন্তু ব্যুৎপত্তিগত ভাবে কলিকাতার সঙ্গে তার কোন যোগ নেই।

এই রকম নানাবিধ ভূল ধারণার জন্য অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন “দেড়শত বৎসরের অধিককাল ধরিয়া ভারতে বৃটিশরাজ্যের রাজধানী হইবার গৌরব ছিল যে নগরীর, সেই কলিকাতা নগরীর নামের ব্যুৎপত্তি এখনও নির্ধারিত হইল না, ইহা বড় আশ্চর্যের বিষয়।” সুনীতিবাবু কলিকাতা বা কলকাতা নাম কিভাবে হল সেই প্রসঙ্গে বলেন, “‘কলিকাতা’ একটি খাঁটি বাংলা শব্দ। ইহার অর্থ, ‘কলি’ বা কলিচুনের জন্য ‘কাতা’ বা শামুকপোড়া। সুতার নুটী বা গোলার হাট বা আড়ত থেকে যেমন ‘সুতানুটী’ নাম, তেমনি কলির বা চুনের ও কলিচুনের জন্য শামুকের আড়ত, এবং চুনের কারখানা হইতে ‘কলি-কাতা’ নাম।”

এই নামকরণের প্রমাণ হিসেবে খোঁজ পাওয়া যায় একই নামের আরও দুটি গ্রামের। এর একটি বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা জেলার লোহাজঙ্গ থানায় অবস্থিত আরেকটি পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার আমতা থানায় অবস্থিত। ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’  গ্রন্থের লেখক বিনয় ঘোষ মহাশয় সুনীতিবাবুর লেখার ইঙ্গিত পেয়ে হাওড়ার রসপুর-কলিকাতা গ্রাম পরিদর্শন করেন। তিনি লক্ষ্য করেন সেই গ্রামে চুনারী আছে এবং কলিচুন তৈরিও হয়। এখানে বেশ কিছু বড় বড় শামুক পোড়ানোর পণ রয়েছে।

কলিকাতার সঙ্গে কলিচুন বা চুনের একটা সম্পর্ক রয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৮৫১খ্রিষ্টাব্দে সিমস সাহেব দ্বারা প্রকাশিত একটি সার্ভে রিপোর্ট থেকেও (F.W. Simms : Reports on the Survey of Calcutta, 1851 ) – সে সময় ‘ডিহি কলিকাতা’র প্রাচীন ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে অন্তত তিনটি রাস্তা ছিল চুন ও চুনারীদের নামে – কলিকাতা উত্তর ব্লকের চুনাপুকুর লেন, চুনাগলি, চুনারপাড়া লেন। অর্থাৎ দেড়শ বছর আগেও কলকাতার এই অঞ্চলে বিশাল একটি চুনারীপাড়া ছিল। গঙ্গার পাশেই চুনারীপাড়ার এই অবস্থান অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। বর্তমানে জায়গার নামগুলি থাকলেও চুনারীপাড়ার অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এ সকল তথ্য কলিকাতার নামের সঙ্গে কলিচুন এবং শামুকের সঙ্গে যোগ প্রমাণ করে।

কলকাতা নাম কিভাবে হল তার বিভিন্ন প্রচলিত মতের সঙ্গে তুলনা করে সব থেকে যুক্তিগ্রাহ্য মতটিকে এখানে তুলে ধরা হল। কলকাতা  আমাদের গর্বের শহর তাই কলকাতা নাম কিভাবে হল তার সঠিক তথ্য সকলের জেনে রাখা প্রয়োজন বলেই আমরা মনে করি।

তথ্যসূত্র


  1. https://www.britannica.com/place/Kolkata
  2. https://en.wikipedia.org/wiki/Etymology_of_Kolkata
  3. পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি (লেখক - বিনয় ঘোষ, ছোট কলিকাতা,  পৃষ্ঠা ৫৯৭-৬০৪)
 

আপনার মতামত জানান