ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী

বাংলাদেশের এক খ্যাতনামা ভাস্কর এবং প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী (Ferdousi Priyabhashini)। পেশাগত দিক থেকে খুব স্বল্প আয়োজনে কীভাবে ঘর সাজানো সম্ভব বা নিজেকে সুন্দর করে তোলা সম্ভব, বিভিন্ন ফেলে দেওয়া অপ্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে নানবিধ অলঙ্কার ও গৃহসজ্জার নানা সরঞ্জাম তৈরির পথ দেখিয়েছেন তিনি। কাঠের গুঁড়িতে তৈরি অনবদ্য শিল্পকর্ম দেখে নড়াইলের চিত্রশিল্পী এম.এস.হুসেন যথেষ্ট প্রশংসা করেছিলেন প্রিয়ভাষিণীর। তার বাইরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের এক রক্তাক্ত ইতিহাসের সাক্ষী ছিলেন তিনি। তাঁর উপরেও অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে পাক বাহিনীর হানাদারেরা। ক্রিসেন্ট জুটমিলের টেলিফোন অপারেটর হিসেবে কর্মরত ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী কে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁরই সহকর্মী। তিনিই বাংলাদেশে প্রথম নারী যিনি জনসমক্ষে নিজেকে ‘বীরাঙ্গনা’ বলে পরিচয় দেন। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে ভূষিত করে।

১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি খুলনায় দাদুর বাড়িতে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী র জন্ম হয়। তাঁর বাবা সৈয়দ মাহবুবুল হক পেশায় খুলনার দৌলতপুর কলেজের অধ্যাপক ছিলেন এবং তাঁর মা রওশন হাসিনা একজন প্রগতিশীল নারী ছিলেন। তাঁর বাবা-মায়ের সম্পর্কের কিছু জটিলতা থাকায় জন্মের পর থেকে মায়ের সঙ্গে দাদুর বাড়িতেই কাটিয়েছেন ফেরদৌসী। তাঁর দাদু উকিল আবদুল হাকিম ছিলেন অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক এবং শিল্পানুরাগী গুণগ্রাহী ব্যক্তি। ‘ফেয়ারি কুইন’ নামের সেই বাড়িতে প্রায় সকলেই শিল্পচর্চার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন। শৈল্পিক পরিবেশে বড়ো হওয়ার কারণেই তাঁর মধ্যে শিল্পচর্চার বীজ রোপিত হয়। ১৯৫৪ সালে তাঁর দাদু আবদুল হাকিম যুক্তফ্রন্টের আমলে স্পিকারের পদে আসীন হন এবং সুপ্রিম কোর্টে কাজের সূত্রে তাঁকে ঢাকায় আসতে হয়। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে দাদুর বাড়ি ছেড়ে পড়াশোনার জন্য ফেরদৌসীকেও দাদুর সঙ্গে চলে আসতে হয় ঢাকায়।

ঢাকায় টিকাটুলির নারীশিক্ষা মন্দির স্কুলে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী র প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তাঁর দাদু স্পিকারের পদে থাকাকালীন মিন্টো রোডের বাড়িতে ফেরদৌসী ও তাঁর মা থাকতেন এবং সেই সময় সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে ভর্তি হন ফেরদৌসী। ‘শের-ই-বাংলা’ উপাধিতে পরিচিত ফজলুল হকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল মিন্টো রোডে তাঁর দাদুর বাড়িতেই। কিন্তু ফেরদৌসীর নয় বছর বয়সে তাঁর বাবা খুলনায় নিয়ে এসে ফেরদৌসীকে ভর্তি করিয়ে দেন খুলনা পায়োনিয়ার গার্লস স্কুলে। এই স্কুল থেকেই এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। তারপরে খুলনা গার্লস স্কুল থেকে এইচএসসি ও স্নাতক পাশ করেন তিনি। ১৯৬৩ সালে পরিবারের অমতে ফেরদৌসী বিবাহ করেন সাতক্ষীরা নিবাসী কাজী সিরাজুল ইসলামকে। এর ফলে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন ফেরদৌসী।

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কর্মজীবন শুরু হয় খুলনা লায়ন্স স্কুলে বাংলা ভাষার জুনিয়র সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে। তারপর পিপলস জুটমিলে টেলিফোন অপারেটরের কাজে যোগ দেন তিনি। পরে বেশি বেতনের আশায় একই পদে ফেরদৌসী যোগ দেন প্ল্যাটিনাম জুটমিলে। এই সংস্থাতেও কয়েক বছর চাকরি করার পরে তিনি যোগ দেন ক্রিসেন্ট জুটমিলে, পদ সেই একই। এর মাঝখানে ইউএনডিপি, কানাডীয় দূতাবাস প্রভৃতি সংস্থায় বিভিন্ন সময় কাজ করেছেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। ইতিমধ্যে তাঁর ও সিরাজুল ইসলামের তিনটি সন্তানের জন্ম হয়েছে কিন্তু তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙে যায় ১৯৭১ সালে।

ফেরদৌসীর পারিবারিক সদস্যরা প্রায় সকলেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র শিবির তাঁদের বাড়িতেই গড়ে উঠেছিল। মুক্তিবাহিনীর এই অস্থায়ী ক্যাম্পের মধ্য দিয়ে সশস্ত্র যোদ্ধাদের কাবার, ওষুধ সবই সরবরাহ করা হতো। এই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীনই তাঁর জীবনে ঘটে যায় এক বিভীষিকাময় ঘটনা। অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে তাঁদের বাড়ি ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং বাড়ির বাইরে থেকে তারা সকলেই ফেরদৌসীকে নেমে আসতে বলে। এই সময়ে এটাই দস্তুর হয়ে গিয়েছিল পুরো বাংলাদেশে যে পাক বাহিনীর বর্বর হানাদারেরা মাঝেমধ্যেই এসে কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে তুলে নিয়ে যেতো, নারীদের উপর চলতো অকথ্য অত্যাচার। খান সেনাদের থেকে বাঁচার জন্য ফেরদৌসী তাঁর পরিচয় গোপন করে প্রথমে বলেন যে ফেরদৌসী খুলনায় চলে গেছে। কিন্তু তাতেও নিস্তার মেলেনি। পাক বাহিনীর মধ্যে কেউ কেউ তাঁকে সহজেই শনাক্ত করে ফেলে। সেই রাতে নিস্তার পেলেও পরের দিন পুনরায় হানা দেয় পাকি বাহিনী। এবারে মদ্যপ অবস্থায় থাকা পাকিস্তানি সেনারা অশ্লীল মন্তব্য ছুঁড়ে দেয় তাঁর দিকে এবং অবশেষে তাঁকে অপহরণ করে গাড়িতে তুলে নেয়। গাড়িতে পাক সেনাদের হাতে চূড়ান্তভাবে গণধর্ষিতা হন ফেরদৌসী। পাকিস্তানি একটি শিবিরে নিয়ে আসা হয় তাঁকে যেখানে তাঁর পাশাপাশি আরো বহু নির্যাতিতা নারীরা ছিলেন। নির্যাতন আর পাশবিক অত্যাচারে ভরা সেই ক্যাম্পের থেকে এক আর্মি অফিসারের সহায়তায় পালাতে সক্ষম হন ফেরদৌসী। সারাজীবনই তাঁকে এই নির্যাতিতার অসম্মান বয়ে বেড়াতে হয়েছে। গণধর্ষিতা হয়ে সামাজিকভাবে তিনি অনেকটাই একা হয়ে পড়েন। বেশিরভাগ শুভানুধ্যায়ীরাই পাশ থেকে সরে যান। পাকিস্তানি ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে এলেও সেই গণধর্ষণের কলঙ্কিত অধ্যায়ের ছাপ তিনি মন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি এবং বারে বারেই তাঁকে সেই ইতিহাস মনে করিয়ে দেওয়া হতো সামাজিকভাবে। নিগৃহীত হওয়ার পরে ক্রিসেন্ট জুটমিলের সহকর্মীরা তাঁকে নানারকম কটূক্তি করতেন যা তাঁকে অত্যন্ত ব্যথিত করতো। এই বিদ্রুপ, কটূক্তি দিনের পর দিন সহ্য করতে না পেরে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালে দ্বিতীয়বার তিনি বিবাহ করেন আহসান উল্লাহ্‌ আহমেদকে। এরপরে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায় সম্পূর্ণরূপে শিল্পচর্চার দিকে। আহসান উল্লাহের সঙ্গে যশোর, শ্রীহট্ট, খুলনা ঘুরে বেড়াতে থাকেন তিনি। শ্রীহট্ট থেকে ফেরার সময়েই কাঠের গুঁড়িতে একটি অনবদ্য শিল্পকর্ম করে ফেলন ফেরদৌসী যা দেখে নড়াইলের বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী এম.এস. সুলতান ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময়ে স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় এলে ফেরদৌসী গণসাহায্য সংস্থা, ফুড অ্যাণ্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন ইত্যাদি সংস্থায় কাজ করেন।

মোটামুটিভাবে নব্বইয়ের দশকের শুরু দিকে কেটে ফেলা গাছের গুঁড়ি, শুকনো পাতা, শুকনো ডালপালা দিয়ে অসম্ভব মুন্সিয়ানায় এক অসাধারণ শিল্পকর্ম তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিতেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। তাঁর নিজের বাড়িতে বাঁশের তৈরি সোফাসেট, টেবিলল্যাম্প, পেয়ারা গাছের ডাল দিয়ে বানানো টেবিল ইত্যাদি সবই তাঁর শিল্পরুচির পরিচয় দেয়, এসবই তাঁর নিজের হাতে বানানো। ১৯৯১ সালে তাঁর প্রথম একক শিল্পপ্রদর্শনী আয়োজিত হয় যশোর ইন্সটিটিউটের গ্রন্থাগারে, আয়োজক ছিল বাংলাদেশের চারুপীঠ। ২০০০ সালে যশোর জেলাতেই চারুপীঠের উদ্যোগে আরেকটি প্রদর্শনী আয়োজিত হয় ফেরদৌসীর। প্রকৃতি থেকেই তিনি সংগ্রহ করতেন ভাস্কর্য নির্মাণের উপাদান। প্রাতিষ্ঠানিক ভাস্কর্যের শিক্ষা না থাকলেও প্রাকৃতিক রীতির অনুকরণ করেই তিনি নিজের অভিজ্ঞতা ও কল্পনার নিরিখে ভাস্কর্য তৈরি করতেন। ঢাকা শহরে পরপর তাঁর অনেকগুলি প্রদর্শনী হয় যার মধ্যে ১৯৯৪ সালে বেঙ্গল ফাউণ্ডেশনে এবং জেসন আর্ট গ্যালারিতে, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমি ও ঢাকা আর্ট গ্যালারিতে, ১৯৯৯তে বাংলাদেশ ন্যাশনাল মিউজিয়ামে, ২০০২ সালে বেঙ্গল গ্যালারি অফ ফাইন আর্টসে ফেরদৌসীর ভাস্কর্যের প্রদর্শনী হয়। এছাড়াও ২০০৪ সালে ঢাকার শিল্পাঙ্গন গ্যালারিতে, ২০০৭ সালে ডটস গ্যালারিতে এবং ২০১০ সালে উল্লেখযোগ্যভাবে ঢাকা আর্ট সেন্টারে তাঁর একক প্রদর্শনী আয়ীজিত হয়। দীর্ঘ তিরিশ বছর পরে একাত্তরের যুদ্ধে নির্যাতিতা নারীর পরিচয় হিসেবে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীই প্রথম জনসমক্ষে নিজেকে ‘বীরাঙ্গনা’ বলে পরিচয় দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের এক যোগ্য শরিক বলে নিজেকে পরিচয় দিতেন তিনি।  একাত্তর সালের মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষীও দিয়েছেন ফেরদৌসী। পরবর্তীকালে আবার ২০১৩ সালে শাহবাগে তরুণ প্রজন্ম একজোট হয়ে মুক্তিযুদ্ধের অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে তখনও সেই তরুণদের হয়ে এক প্রতিবাদী সৈনিকের মতো গর্জে উঠেছিলেন ফেরদৌসীও।

২০০৪ সালে প্রথম ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’ ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে ‘হিরো’ মর্যাদা পান তিনি। এছাড়া শিল্পকলায় কৃতিত্বের জন্য চাদেরনাথ পদক, অনন্য শীর্ষ পদক, ওয়াইএমসিএ-র তরফ থেকে রৌপ্যজয়ন্তী পদক এবং মানবাধিকার পদক লাভ করেছেন ফেরদৌসী। সবশেষে ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান হিসেবে স্বাধীনতা দিবস পদকে ভূষিত করে।

২০১৮ সালের ৬ মার্চ ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মৃত্যু হয়।

আপনার মতামত জানান