ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তীর মৃত্যু

ভীষ্মের পরাজয় ও পতন

মহাভারতের ভীষ্মপর্বের একেবারে শেষে মহাবীর ভীষ্মের পরাজয় ও পতন বর্ণিত আছে। ভীষ্ম তাঁর বাবা মহারাজ শান্তনুর থেকে বর পেয়েছিলেন যে, নিজের ইচ্ছা ছাড়া কেউ তাঁকে বধ করতে পারবে না। এজন্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছিলেন। যুদ্ধের কয়েকদিন পর তা দেখে যুধিষ্ঠিরের চিন্তা বাড়তে থাকে। নবম দিন যুদ্ধের শেষে রাত্রে পান্ডবরা সবাই মিলে লুকিয়ে লুকিয়ে ভীষ্মের শিবিরে গেলেন। যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে প্রণাম করে হাত জোড় করে জিজ্ঞাসা করলেন, “দাদামশাই! আমরা তো কিছুতেই আপনাকে হারাতে পারছি না। আমাদের রাজ্য ফিরে পাওয়ার তাহলে কী উপায় হবে? আর প্রতিদিন যে এতো লোক মারা যাচ্ছে তাও আমরা দেখতে পারছি না। আপনি দয়া করে আপনাকে বধ করার উপায় বলে দিন!”

ভীষ্ম সেই কথা শুনে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “বাছা! আমার হাতে অস্ত্র থাকলে দেবতারাও আমাকে হারাতে পারবেন না। তবে আমি তোমাকে একটি উপায় বলে দিচ্ছি। তোমাদের পক্ষের শিখণ্ডী যেহেতু আগে নারী ছিলেন, তাই আমি তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারব না। তোমরা শিখণ্ডীকে সামনে রেখে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করো। আমি অনুমতি দিচ্ছি, তোমরা যত ইচ্ছা আমাকে মারবে। আমার এই কথামত কাজ করলে নিশ্চয়ই তোমাদের জয় হবে।”

পান্ডবরা এই কথা শুনে নিজেদের শিবিরে ফিরে এলেন। পরেরদিন সকালে ব্যূহ সাজানোর সময় পান্ডবপক্ষের সৈন্যদলের সবথেকে সামনে থাকলেন শিখণ্ডী, আর বাকি পান্ডবসৈন্যরা তাঁর পিছনে থেকে যুদ্ধে নামলেন। যুদ্ধের শুরু থেকেই ভীষ্ম আগের মতোই একধার থেকে পান্ডবসৈন্য মারতে থাকলেন। শিখণ্ডী তাঁকে বারণ করবার জন্য ক্রমাগত বাণ মারলেও ভীষ্ম সেদিকে মনোযোগ দিলেন না। এইভাবে ভীষ্মকে ভয়ানক যুদ্ধ করতে দেখে অর্জুন রাগের ভরে কৌরবসৈন্যদের মারতে শুরু করলেন। তাঁকে কেউ আটকাতে পারল না। এমন কাণ্ড দেখে দুর্যোধন ভীষ্মকে বিদ্রুপ করে বললেন, “আপনি ভালো করে যুদ্ধ করুন! অর্জুন তো নাহলে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে।”

ভীষ্ম উত্তর দিলেন, “আমি তোমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, রোজ পান্ডবদের দশহাজার জন সৈন্যকে হত্যা করব। আমি আমার প্রতিজ্ঞা রেখেছি। এবার আজ যুদ্ধে আমি নিজের প্রাণ দিয়ে, তুমি যে এতদিন আমাকে অন্ন দিয়েছ, সেই ঋণ শোধ করব।”এই বলে ভীষ্ম প্রাণপণে যুদ্ধ শুরু করলেন। এদিকে শিখণ্ডীর বাণের বিরাম নেই। অর্জুন ক্রমাগত তাঁকে উৎসাহ দিচ্ছেন। অর্জুনকে আটকাতে দুঃশাসন এলেও তিনি কিছুই করতে পারলেন না। এদিকে ভগদত্ত, কৃপ, শল্য, কৃতবর্মা, বিন্দ, অনুবিন্দ, জয়দ্রথ, চিত্রসেন, বিকর্ণ, দুর্মর্ষণ প্রভৃতিরা মিলে ভীমকে আক্রমণ করেছেন। কিন্তু ভীম একাই হাজার হাজার বাণে তাঁদের সবাইকে অস্থির করে দিলেন। এইসময় অর্জুন এসে ভীমের সঙ্গে যোগ দিলেন। তা দেখে ভীষ্ম, দুর্যোধন, বৃহদ্বল প্রভৃতি সবাই সেখানে এসে যুদ্ধ শুরু করলে যুদ্ধ ভীষণ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করল। এর মধ্যেও শিখণ্ডী ক্রমাগত ভীষ্মের গায়ে বাণ মেরে চলেছেন। ভীষ্ম তাঁর দিকে ভ্রুক্ষেপও করছেন না।

হঠাৎ যুধিষ্ঠিরকে দেখতে পেয়ে ভীষ্ম তাঁকে ডেকে বললেন, “যুধিষ্ঠির! এতদিন যুদ্ধে আমি অনেক জীবহত্যা করেছি। আর আমার বাঁচার ইচ্ছা নাই। যদি আমাকে সুখী করতে চাও, তবে তাড়াতাড়ি অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে বধ করো।” যুধিষ্ঠির ভীষ্মের মনের ভাব বুঝতে পেরে সবাইকে ডেকে বললেন, “তোমরা সবাই এসো, আজ ভীষ্মকে মারতে পারলেই আমাদের জয় হবে।” তখন শিখণ্ডীকে সামনে রেখে পান্ডবরা সবাই মিলে ভীষ্মকে আক্রমণ করলেন। কৌরবপক্ষের বীর যোদ্ধারাও ছুটে এলেন ভীষ্মকে বাঁচাতে। দুই পক্ষের ভীষণ যুদ্ধে পৃথিবী কেঁপে উঠল। মেঘের ডাকের মতো ধনুকের টঙ্কারের শব্দ শোনা যেতে লাগল। দুন্দুভির আওয়াজে সবার কানে তালা ধরে যেতে লাগল। দেখতে দেখতে পান্ডবদের ‘সোমক’ নামে সৈন্যদল ভীষ্মের বাণে শেষ হয়ে গেল। শিখণ্ডী ভীষ্মকে বাণ মারতে এক মুহূর্তও থামছেন না। ভীষ্ম হাসতে হাসতে তাঁর সব আঘাত অগ্রাহ্য করে ক্রমাগত পান্ডবসৈন্য বধ করছেন। দুর্যোধন আর অন্যান্য কৌরবরা প্রাণপণে চেষ্টা করছেন ভীষ্মকে বাঁচাতে, কিন্তু অর্জুনের বাণে তাঁদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। অর্জুনের প্রহার সহ্য করতে না পেরে একে একে কৃপ, শল্য, বিকর্ণ, বিংশতি সবাই যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। কিন্তু ভীষ্ম কোনোদিকে না তাকিয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। দশহাজার গজারোহী (হাতিতে চেপে যে সৈন্যরা যুদ্ধ করে), সাতজন মহারথ, একহাজার হাতি, দশহাজার ঘোড়া, তাছাড়া মহারাজ বিরাটের ভাই শতানীক প্রভৃতি হাজার হাজার যোদ্ধা সেদিন ভীষ্মের হাতে মারা যান।

এমন সময় অর্জুন ভীষ্মের ধনুক কেটে ফেললেন। তা দেখে দ্রোণ, কৃতবর্মা, জয়দ্রথ, ভূরিশ্রবা, শল, শল্য ও ভগদত্ত মিলে অর্জুনকে আক্রমণ করায় সাত্যকি, ভীম, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট, ঘটোৎকচ ও অভিমন্যু অর্জুনকে সাহায্য করতে ছুটে এলেন। ভীষ্ম নতুন ধনুক হাতে নিলে অর্জুন আবার তা কেটে দিলেন। তিনি একটি শক্তি ছুঁড়ে মারলে অর্জুন তাও নষ্ট করলেন। তখন ভীষ্ম মনে মনে ভাবলেন, “আমি এখনো এক বাণেই পান্ডবদের মারতে পারি, যদি কৃষ্ণ তাদের সঙ্গে না থাকে। কিন্তু আমি পান্ডবদের মারব না, শিখণ্ডীর সাথে যুদ্ধও করব না। এই আমার মরবার সুযোগ।”

ভীষ্মের মনের কথা জানতে পেরে আকাশ থেকে অন্য বসুরা বলে উঠলেন, “তাই ঠিক ভীষ্ম! আর যুদ্ধে কাজ নেই।”
এ কথায় স্বর্গে দুন্দুভি বেজে উঠল। আকাশ থেকে দেবতারা ভীষ্মের উপর পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন। আর এইসময় থেকে ভীষ্ম অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধের চেষ্টা ছেড়ে দিলেন। অন্য পান্ডবসৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য তিনি ঢাল ও তলোয়ার হাতে রথ থেকে নামতে যেতেই অর্জুন তাও কেটে দিলেন। কৌরবরা ভীষ্মকে রক্ষার জন্য অনেক চেষ্টা করছেন, কিন্তু অর্জুনের জন্য সবই বিফল হয়ে যাচ্ছে। অর্জুনের বাণে ভীষ্মের শরীর এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে যে সামান্যতম জায়গাও আর বাকি নেই। এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত হয় সূর্য অস্ত যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে ভীষ্ম রথ থেকে পড়ে গেলেন। গোটা পৃথিবী কেঁপে উঠল। ‘হায়! হায়!’ করে যোদ্ধারা কেঁদে উঠলেন। ভীষ্মের শরীরে এতো বাণ বিঁধেছিল যে রথ থেকে পড়ে গেলেও তাঁর শরীর মাটি স্পর্শ করল না। হাজার হাজার বাণের বিছানা বা ‘শরশয্যা’য় ভীষ্ম শুয়ে রইলেন।

শরশয্যায় শুয়ে ভীষ্ম মৃত্যুর কথা ভাবতে লাগলেন। এমন সময় আকাশ থেকে দেবতারা বললেন, “হে মহাবীর! সূর্যদেব এখনো আকাশের দক্ষিণভাগে রয়েছেন। এ মহাপুরুষের মৃত্যুর সময় নয়। আপনি এমন সময়ে দেহত্যাগ করবেন?” সেইসময় আকাশ দিয়ে মানস সরোবরের দিকে একঝাঁক হাঁস উড়ে যাচ্ছিল। তারা বলল, “সূর্যদেবের দক্ষিণায়ন এখনো শেষ হয়নি। মহাত্মা ভীষ্ম কি এইসময়েই দেহত্যাগ করবেন?” ভীষ্ম বুঝতে পারলেন, এগুলি সাধারণ হাঁস নয়। এঁরা তাঁর মা গঙ্গাদেবীর পাঠানো স্বর্গের ঋষিরা। তাই ভীষ্ম তাঁদের বললেন, “আমার বাবা আমাকে ইচ্ছামৃত্যুর বর দিয়েছিলেন। আমি সত্য বলছি, সূর্যদেব আকাশের উত্তরভাগে না যাওয়া পর্যন্ত আমি দেহত্যাগ করব না।”

ভীষ্ম রথ থেকে পড়ে যাওয়া মাত্র যুদ্ধ থেমে গেল। পান্ডবদের দলে মহাশঙ্খ বেজে উঠল। ভীম আনন্দে নৃত্য করতে লাগলেন। আর কৌরবপক্ষের যোদ্ধারা দুঃখে কাঁদতে লাগলেন। দ্রোণ অজ্ঞান হয়ে রথ থেকে পড়ে গেলেন। তারপর সবাই নিজের নিজের বর্ম ও অস্ত্র ফেলে দিয়ে মাথা হেঁট করে ভীষ্মের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। এইভাবে ভীষ্মের পরাজয় ও পতন সম্পূর্ণ হল।

তথ্যসূত্র


  1. কালীপ্রসন্ন সিংহ বিরচিত ‘মহাভারত’, ভীষ্মপর্ব, অধ্যায় ১০৮-১২০, পৃষ্ঠা ৪৭৮-৫০০
  2. ‘ছেলেদের মহাভারত’, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, বসাক বুক স্টোর প্রাইভেট লিমিটেড, তৃতীয় মুদ্রণ, ভীষ্মপর্ব, পৃষ্ঠা ১৩২-১৩৯

আপনার মতামত জানান