দুর্গাপ্রতিমার শিল্পরীতি

দুর্গাপ্রতিমার শিল্পরীতি

বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুজো দুর্গাপুজো। বহু বহু কাল ধরে বাঙালির সংস্কৃতিতে দুর্গাপূজার প্রচলন হয়ে এসেছে। মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গার নানা রূপ আমরা দেখতে পাই তার বিগ্রহে। কখনো তিনি বরাভয়দাত্রী, কখনো আবার রণচণ্ডী, কখনো স্নিগ্ধ অপার স্নেহময়ী মায়ের রূপে প্রতিমায় বিম্বিত হন দেবী দুর্গা। শিল্পীর তুলির টানে আর মুন্সিয়ানায় দেবী প্রতিমার বিশেষ বিশেষ রূপ বা দল তৈরি হয়ে যায়। প্রাচীন সাবেকি দেবী প্রতিমাগুলির বিচার করলে লক্ষ করা যাবে বিশেষ বিশেষ শিল্পরীতির ছাপ তাতে স্পষ্ট যাকে চলতি কথায় ‘ঘরানা’ বলা হয়। এক্ষেত্রে দুটি নাম খুবই জনপ্রিয় – বিষ্ণুপুর ঘরানা আর কংসনারায়ণ ঘরানা। এছাড়াও দেবীর প্রতিমার পাশাপাশি চালচিত্রের এক বিরাট ভূমিকা রয়েছে। সব মিলিয়েই দুর্গাপ্রতিমার শিল্পরীতি পূর্ণ হয়ে ওঠে। বহু আগে দুর্গা প্রতিমা নির্মিত হতো পাথর দিয়ে। মাটির প্রতিমার তখনো সেরকম চল হয়নি। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের রাজা জগৎমল্ল এবং রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণকেই প্রথম উদ্যোগ নিয়ে মাটির দেবী প্রতিমা নির্মাণ করাতে দেখা যায়। ফলে তাঁদের হাত ধরেই দুর্গা প্রতিমার দুই ঐতিহ্যবাহী শিল্পরীতির জন্ম হয়েছে।

বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী দেবীর প্রতিমা

১) বিষ্ণুপুর রীতির প্রতিমা

রাজা জগৎমল্লের নির্দেশেই বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মাতার মূর্তি প্রথম নির্মিত হয়। সময়টা ৯৯৭ সাল। সেই প্রথম বিশেষ রীতিতে জগৎমল্ল দেবী মূর্তি নির্মাণ করান আর সেটাই বিষ্ণুপুর রীতির প্রতিমা বলে চিহ্নিত হয়ে যায়। বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরও তাঁরই তৈরি। বাঁকুড়ার বিভিন্ন প্রান্তে এবং বাংলার কিছু কিছু স্থানে এই রীতিতে নির্মিত দেবী প্রতিমায় দেখা যায় একই চালের মধ্যে উপরের দিকে অধিষ্ঠিত আছেন গণেশ এবং কার্তিক আর নীচের দিকে লক্ষ্মী ও সরস্বতী। চালচিত্রের পিছনে এই রীতিতে কোনো চিত্রকলা অঙ্কিত থাকে না আর তার বদলে দেখা যায় শিব এবং নন্দী-ভৃঙ্গিকে। ।

কংসনারায়ণ রীতিতে নির্মিত কৃষ্ণনগর রাজবাড়ীর প্রতিমা

২) কংসনারায়ণ রীতির প্রতিমা

ইতিহাসে দেখা যায় তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বাংলায় একবার জাঁকজমকে সাড়ম্বরে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন যা আজও বাঙালিদের মধ্যে কিংবদন্তীর রূপ নিয়েছে। কারো মতে মোগল আমলে, আবার কারো মতে পাঠান যুগে কংসনারায়ণ এই পুজো করেছিলেন যাতে ব্যয় হয়েছিল প্রায় সাত-আট লক্ষ টাকা। তাহেরপুরের রাজা হলেও সেকালের বাংলায় তিনি বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম ছিলেন। এই কংসনারায়ণের প্রবর্তিত যে বিশেষ রীতি তাতে লক্ষ করা যায় বিষ্ণুপুর রীতির ঠিক উলটো অবস্থান। অর্থাৎ গণেশ ও কার্তিক এই রীতিতে নীচের দিকে অধিষ্ঠিত আর সরস্বতী এবং লক্ষ্মী আছেন উপরের দিকে। এই রীতিতে প্রতিমার পিছনে থাকা অর্ধচন্দ্রাকার চালচিত্রের মধ্যে অঙ্কিত দশমহাবিদ্যার রূপটি বিশেষ নজর কাড়ে। শোনা যায় নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কংসনারায়ণ রীতিকে প্রভূত জনপ্রিয়তা দিয়েছিলেন। গাঢ় হলুদ বর্ণের দেবী দুর্গার প্রতিমা আজও কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে গেলেই দেখা যায়। দেখা গেছে যে বাংলার বেশিরভাগ সাবেকি বনেদিয়ানার পুজোতে এই রীতির প্রতিমাই পুজো করা হয়ে থাকে। এর কারণ বলতে সেকালে এর জনপ্রিয়তার কথাই ভাবতে হয়। শুধু বাংলার মধ্যেই নয়, বরং বাংলার বাইরেও বহু জায়গায় এই রীতির ব্যবহার ছড়িয়ে পড়েছিল।

তবে শুধু যে দুর্গাপ্রতিমার শিল্পরীতি লক্ষণীয় তা কিন্তু নয়। চালচিত্রের কারুকার্যও বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে যা দুর্গাপ্রতিমার শিল্পরীতিরই অঙ্গ। সাবেকি প্রতিমার ক্ষেত্রে টানা চাল, বাংলা চাল, মঠচৌড়ি চাল কিংবা মার্কিনি চাল লক্ষ করা যায়। একেকটি চালচিত্রের একেকরকম রীতি। প্রতিমার পিছনে তিনটি চালি যদি উঠে যায় চূড়ার মতো তাকে বলা হয় মঠচৌড়ি চাল আর অন্য একটি ক্ষেত্রে দেখা যায় শুধুমাত্র দুর্গা, লক্ষ্মী আর সরস্বতীর মাথার পিছনেই তিনটি ছোটো অর্ধবৃত্তাকার চাল রয়েছে যাকে টানা চাল বা টানাচৌড়ি চাল বলা হয়। কার্তিক আর গণেশের বিগ্রহ এক বিশেষ প্রকার চালিতে খানিকটা বাইরের দিকে থাকে, তাকে বলা হয় মার্কিনি চাল। এই চালচিত্রই বেশিরভাগ বনেদি পুজোয় দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে হাটখোলার দত্তবাড়ির  সাবেকি পুজোয় দেবীপ্রতিমার মঠচৌড়ি চালি দেখা যায়। আবার রানি রাসমণির জানবাজারের পুজোয় দেবীর চালচিত্র বাংলা চাল রীতির। দর্জিপাড়ার রাজকৃষ্ণ মিত্রবাড়ির যে বনেদি দুর্গাপুজো তাতে প্রতিমায় মঠচৌড়ি চালির উপস্থিতি লক্ষণীয়। তবে এছাড়াও আরো নানা শ্রেণিতে চালচিত্রগুলি পৃথক করা হতো। চালচিত্রে কী আঁকা হচ্ছে তার উপর একেক রকম নামকরণের রীতি – বৃন্দাবনী, রামচন্দ্রী, দশাবতারি বা কৈলাসী চাল এরূপ বিভাজন দেখা যায়। কোথাও কোথাও আবার চালচিত্রের মাথায় দশমহাবিদ্যার রূপ অঙ্কিত থাকে, আঁকা থাকে দেবীর সঙ্গে অসুরদের যুদ্ধের দৃশ্যও। মূলত একচালার সাবেকি মূর্তিগুলিতেই এই চালচিত্রের কারুশিল্পগুলি নজরে পড়ে। বর্তমানে পাঁচ চালার ঠাকুর হওয়াতে চালচিত্রের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সৌন্দর্য আর নেই।

তথ্যসূত্র


  1. দুর্গাপূজা ও কিছু কথা, সনজিৎ ঘোষ, অর্পিতা প্রকাশনী (২০১৬)।
  2. দুর্গোৎসবের উৎস সন্ধানে, অব্জ কেশব কর, দে'জ পাবলিশিং।
  3. বাংলায় পটের দুর্গা, দীপঙ্কর ঘোষ, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৫)।
  4. দুর্গা রূপে রূপান্তরে, পূর্বা সেনগুপ্ত,মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (২০১৬)

One comment

আপনার মতামত জানান