দাঁশাই উৎসব

দাঁশাই উৎসব

আপামর বাঙালি যখন দেবী দুর্গার আরাধনায় মেতে ওঠে, শুভ শক্তির সূচনা এবং অশুভ শক্তির বিনাশের আশায় ষোড়শোপচারে পুজো চলে দেবীর, ঠিক সেই সময়েই মহানবমীর দিন ভারতের বেশ কিছু উপজাতি সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব লোকবিশ্বাসে পূজা করেন মহিষাসুরের। প্রচলিত পুরাণের দুর্গার বিপ্রতীপে সাঁওতাল, কোল, ভীল, কুর্মি, মুণ্ডা প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষের আরাধ্য হয়ে ওঠেন হুদুড় দুর্গা। তিনিই আসলে মহিষাসুর যাঁকে দেবী অনৈতিক যুদ্ধে হত্যা করেছিলেন বলে মনে করেন এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। আর এই হুদুড় দুর্গার পুজোর সময়েই মহানবমীর দিন সমস্ত আদিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষ পালন করেন এই দাঁশাই উৎসব (dashain festival)। হুদুর দুর্গাই হোক আর এই দাঁশাই উৎসবই হোক উভয়ই প্রচলিত দুর্গার পুরাণকে প্রতিপ্রশ্ন করে এবং ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যকে নস্যাৎ করতে চায়।

আদিবাসী কৌম সমাজে হুদুড় দুর্গা একজন মহানুভব, পরাক্রমী রাজা তথা শাসক ছিলেন যিনি কখনোই নারী ও শিশুকে প্রহার করতেন না। আর এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আর্য সাম্রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে আর্যদের প্রেরিত দুর্গা ছলনা করে হুদুড় দুর্গাকে বিবাহ করে এবং বিবাহের নবম রাতেই তাঁকে হত্যা করে। এই হুদুড় দুর্গা আসলে দুর্গার হাতে নিহত অসুর। অসুর নামে বাস্তবিকই একটি উপজাতি রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশে। সেই অসুরদের আরাধ্য দেবতা এই হুদুড় দুর্গার পুজোয় পালিত হয় দাঁশাই উৎসব। আদিবাসীদের ভাষায় ‘দাঁশাই’ উৎসবকে বলা হয় ‘দাঁশায় দাঁড়ান’। সাঁওতালিদের সংস্কৃতিতে বছরের একটি মাসের নাম দাঁশায় যা কিনা বাঙালিদের শরৎকালের সমসাময়িক। এই মাসেই এক দুঃখ-শোকের উৎসব পালন করে সাঁওতালি ও অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষেরা। এই হুদুড় দুর্গার কাহিনি যদিও খেরওয়াল জনগোষ্ঠীর মধ্যেই বেশি প্রচলিত। কিন্তু প্রশ্ন হল শোক কেন? আসলে তাঁদের উপাস্য শাসক হুদুড় দুর্গাকে এই দিনেই ঘুমন্ত অবস্থায় দুর্গা হত্যা করেছিলেন বলে সকলে বিশ্বাস করেন আর তাই এই দিনে তাঁরা হুদুড় দুর্গাকে স্মরণ করে ভুয়ং বাজনা নিয়ে নাচ-গান করেন, সেরেঞ আসরে মেতে ওঠেন সকলে। এই উৎসবের গান দাঁশাই গান আর বিশেষ নৃত্যশৈলীকে দাঁশাই নাচ বলা হয়ে থাকে। আদিবাসী সমাজের লোকবিশ্বাসে দেবী দুর্গা এক ছলনাময়ী বিশ্বাসঘাতিনী নারী। ফলে বোঝাই যায় এই উৎসবকে ঘিরে এক আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্বই সামনে উঠে আসে। আশ্বিন মাসে অনুষ্ঠিত হয় এই দাঁশাই পরব। এই সময় শুকনো লাউয়ের খোল দিয়ে আদিবাসীরা তৈরি করে বিশেষ ধরনের সেই বাদ্যযন্ত্র যার নাম ‘ভুয়ং’। পুরুষরা এই সময় শাড়ি পরে নারীর বেশে সজ্জিত হয়, তাদের মাথায় থাকে ময়ূরের পালক। দাঁশাই নাচের সময় অনেকক্ষেত্রেই পুরুষরা হাতে, গলায় নানাবিধ অলঙ্কার পরে থাকেন। পুরুলিয়া, বীরভূম, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ইত্যাদি নানা জায়গায় আদিবাসীরা এই সময় বীর হুদুড় দুর্গার মৃত্যুদিন হিসেবে শোকপালন করে থাকে। দাঁশাই গানের মূল বৈশিষ্ট্য হল এই গান গাওয়ার মাঝে মাঝেই সকলে সমবেত স্বরে ‘হায় হায় হায়রে’ বলতে থাকে যা তাদের শোক প্রকাশের মাধ্যম।

দাঁশাই উৎসব এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরেকটি পৌরাণিক কিংবদন্তী। শোনা যায় আয়নম্‌ ও কাজল নামে দুজন সাঁওতাল নারী জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে গেলে কয়েকজন আর্য তাদের অপহরণের চেষ্টা করে এবং এই ঘটনা রাখালদের চোখে পড়ায় তারা গ্রামের মানুষদের ডাকতে থাকে। কিন্তু এই সময়ে হুদুড় দুর্গা ছুটে যান অঈ দুই নারীকে উদ্ধার করার জন্য। সকল গ্রামবাসী এই সময় লাউয়ের খোলার মধ্যে তিরের ফলা লুকিয়ে রেখে, মহিলাদের পোশাক পরে ঐ দুই নারীকে উদ্ধার করতে বেরোয়। পথে প্রবল বৃষ্টিতে সকলকেই জল কমার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এই অপেক্ষার সময়েই যদি সেই মেয়ে দুটিকে খুঁজে না পাওয়া যায় তাই সকলেই ‘হায় হায়’ করতে থাকে। এখান থেকেই ‘দাঁশাই’ কথাটির একটি ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সাঁওতালি ভাষায় ‘দাঁ’ মানে হল জল আর ‘শাঁই’ মানে কমে যাওয়া। ফলে এই বিশেষ উৎসবের সঙ্গে এই পৌরাণিক ঘটনার একটি অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। পুরুলিয়ার ভূমিপুত্র খেরওয়াল জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই দাঁশাই উৎসবের সময় কাঠি নাচের প্রচলন রয়েছে। অনেকে আবার দাঁশাই মাসের পূর্ণিমার দিন এলেই গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে ওষধি গাছ, অন্যান্য উপকারী গাছের শিকড়-বাকড়, ছাল ইত্যাদি সংগ্রহ করে রাখেন ভবিষ্যতের জন্য। আসলে তাঁদের বিশ্বাস যে এই সময়েই গাছের পাতা থাকে খুব সতেজ। তাই বহু মানুষ একে প্রকৃতির উপাসনার সময় মনে করে জঙ্গল থেকে গাছ-গাছালির পাতা, ছাল-মূল ইত্যাদি নিয়ে আসে যা উপজাতি সমাজে জীবনদায়ী ওষুধের কাজ করে। সবমিলিয়ে হুদুড় দুর্গার মৃত্যুর স্মরণে পালিত আদিবাসীদের এই শোকানুষ্ঠান বাংলা তথা ভারতের লোকসংস্কৃতির এক উল্লেখযোগ্য অংশ।


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

One comment

আপনার মতামত জানান