ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তীর মৃত্যু

কৃষ্ণ ও কর্ণের কথোপকথন

মহাভারতের উদ্যোগপর্বে ১৩৮তম অধ্যায় থেকে ১৪০তম অধ্যায় জুড়ে কৃষ্ণ ও কর্ণের কথোপকথন বর্ণিত আছে। পান্ডবদের বনবাস ও অজ্ঞাতবাসের পালা শেষ হলে তাঁরা নিজেদের রাজ্য ফিরে পাওয়ার উপায় খুঁজতে লাগলেন। তখন দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের শেষ চেষ্টা হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ পান্ডবদের দূত হয়ে হস্তিনাপুরে এলেন। কিন্তু তিনি অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও দুর্যোধন কিছুতেই বিনা যুদ্ধে পান্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দিতে রাজি হলেন না। খালি হাতেই ফিরে যেতে হল শ্রীকৃষ্ণকে। ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই শুরু হল কৃষ্ণ ও কর্ণের কথোপকথন ।

পিসিমা কুন্তীর সঙ্গে দেখা করে কৃষ্ণ হস্তিনাপুর ছেড়ে যাওয়ার জন্য নিজের রথে উঠলেন। যাওয়ার সময় তিনি অঙ্গরাজ কর্ণকে দেখতে পেয়ে তাঁকেও নিজের রথে তুলে নিলেন। রথ চলতে লাগল। হস্তিনাপুরের নদীতীরে রথ পৌঁছালে কৃষ্ণ সারথি দারুককে রথ থামাতে ও কিছু সময়ের জন্য রথ থেকে দূরে যেতে বললেন। দারুক কৃষ্ণের আদেশ পালন করল। শুরু হল কৃষ্ণ ও কর্ণের কথোপকথন। কৃষ্ণ রথের উপরেই কর্ণকে বললেন, “অঙ্গরাজ কর্ণ! আপনি তো সনাতন ধর্মশাস্ত্রের সূক্ষ্ম নীতিগুলির মর্মও জানেন! আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে কন্যার গর্ভে ‘কানীন’ এবং ‘সহোড়’ নামে দুই প্রকার সন্তান জন্মে থাকে। শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিরা সেই কন্যার স্বামীকেই সেই সন্তানদের পিতা বলে থাকেন। কর্ণ, আপনি কুমারী অবস্থায় কুন্তীর গর্ভে জন্মেছেন, সেই কারণে আপনি কুন্তীর কানীন পুত্র এবং মহারাজ পান্ডুই আপনার পিতা। সুতরাং, আপনি আমার সঙ্গে চলুন, হস্তিনাপুরের রাজা আপনিই হবেন। আপনি এখন আমার সঙ্গে উপপ্লব্য নগরে গেলে যুধিষ্ঠির এবং বাকি পান্ডবরা আপনাকে তাঁদের বড় ভাই বলে জানতে পারবে। আমার বিশ্বাস, একথা জানতে পারলে যুধিষ্ঠির আপনাকেই রাজা বলে ঘোষণা করবেন। বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা যথানিয়মে আপনার অভিষেক করবেন। যুধিষ্ঠির আপনার যুবরাজ হবেন এবং আপনাকে সিংহাসনে বসিয়ে তিনি নিজে চামর দিয়ে আপনাকে হাওয়া করবেন। ভীম আপনার মাথায় সাদা ছাতা ধরবেন। অর্জুন আপনার রথের সারথি হবেন এবং নকুল, সহদেব সবসময় আপনারই আদেশ পালন করবেন। অন্ধক, বৃষ্ণি এবং দশার্হবংশীয়রা ও দশার্ণদেশীয়রা সবাই আপনার পরিবার হবেন। এইভাবে আপনি পান্ডবদের সাথে মিলে জপ, হোম এবং আরও অন্যান্য মাঙ্গলিক কাজে নিযুক্ত থেকে রাজ্যভোগ করতে থাকুন। নক্ষত্রেরা যেমন চাঁদকে সবসময় ঘিরে থাকে, তেমনই পান্ডবরা আপনাকে সারাক্ষণ ঘিরে থাকুক। আপনি যথানিয়মে রাজ্যশাসন করতে থাকুন এবং কুন্তীদেবীর আনন্দের কারণ হন। আজ থেকে পান্ডবদের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব হোক এবং এর ফলে শত্রুরা ব্যথিত হোক।”

এই সব কথা শুনে কর্ণ বললেন, “বাসুদেব! আপনি আমার ভালোর জন্য বন্ধু হিসেবে যা যা বললেন তা সবই সত্য। আপনি যা যা জানেন, আমিও তা সবই জানি। ধর্মশাস্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী সত্যিই আমি পান্ডুর সন্তান। কুন্তীদেবী কুমারী অবস্থায় সূর্যদেবের ঔরসে আমাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন এবং আমার জন্মের পরে সূর্যদেবের কথামতই আমাকে ত্যাগ করেছিলেন। কৃষ্ণ! আমিই কুন্তীদেবীর সেই কানীন সন্তান এবং ধর্মত মহারাজ পান্ডুই আমার পিতা। কিন্তু যাতে আমার মঙ্গল না হয়, সেইভাবেই কুন্তীদেবী আমাকে ত্যাগ করেছিলেন। তারপর সারথি অধিরথ আমাকে কুড়িয়ে পেয়ে ঘরে নিয়ে আসেন এবং নিজের স্ত্রী রাধার হাতে আমাকে তুলে দেন। আমাকে দেখেই রাধার স্তনে দুধ এসেছিল এবং সেই থেকে রাধাই আমাকে লালন-পালন করেছিলেন। তাহলে আমার মত ধর্মজ্ঞ এবং শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন লোক কী করে সেই রাধার পিন্ডলোপ করতে পারে? অধিরথ আমাকে নিজের সন্তানের মতই স্নেহ করেন এবং আমিও তাঁকে বাবার মতোই ভালোবাসি। তাঁদের ঘরে থেকেই আমার অনেক মহিলার সাথে বিয়ে হয়েছে এবং আমার পুত্র ও পৌত্র জন্ম নিয়েছে। আমি আমার স্ত্রীদের খুব ভালোবাসি। গোবিন্দ! সারা পৃথিবীর রাজত্ব, রাশি রাশি সোনা, আনন্দ কিংবা ভয়ের বশে এই সব সম্পর্ক আমি মিথ্যা হয়ে যেতে দিতে পারব না। আবার আমি দুর্যোধনের বন্ধু হয়ে গত তেরো বছর আনন্দে রাজ্যশাসন করেছি। দুর্যোধন অর্জুনের বিপরীতে আমার উপর ভরসা করেই এই যুদ্ধের উদ্যোগ করেছেন এবং অস্ত্র-শস্ত্র সংগ্রহ করছেন। সুতরাং জনার্দন, মৃত্যুভয় বা রাজ্যলোভের বশে আমি দুর্যোধনের সঙ্গে মিথ্যাচার করতে পারি না। তাছাড়া, আমার আর অর্জুনের যুদ্ধ না হলে আমাদের দুজনেরই নিন্দা হবে। আমি জানি আপনি যা যা বলেছেন সব আমার ভালোর জন্য বলেছেন এবং পান্ডবরাও ঠিক তাই তাই করবেন। কিন্তু আমার অনুরোধ, আপনি দয়া করে এখন এসব কথা গোপন রাখুন। কারণ যুধিষ্ঠির জানতে পারলে তিনি আমাকে রাজত্ব দিয়ে দেবেন। আমিও তা রাখতে পারব না, আগে দেওয়া কথা অনুযায়ী, আমাকে দুর্যোধনকে তা দান করে দিতে হবে।

“ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরেরই রাজা হওয়া মানায়, কারণ আপনি যাঁর নেতা এবং অর্জুন যাঁর যোদ্ধা তাঁর পক্ষে গোটা পৃথিবীটাই নিজের রাজ্য।
“এই যুদ্ধ হবেই। আপানি শুধু দেখবেন বয়স্ক এবং জ্ঞানী ক্ষত্রিয়দের যেন বৃথা মৃত্যু না হয়। সব বীররাই যেন যুদ্ধ করতে করতে অস্ত্রের আঘাতে প্রাণ দিয়ে স্বর্গে যেতে পারে। যতদিন পৃথিবীতে পর্বত ও নদী থাকবে, ততদিন এই ধর্মযুদ্ধের কথা মানুষ মনে রাখবে। আপনি শুধু আমার জন্মের কথা গোপন রেখে যুদ্ধ করার জন্য অর্জুনকে আমার কাছে নিয়ে আসবেন।”

কৃষ্ণ ও কর্ণের কথোপকথন এর সময় কর্ণের এই কথা শুনে কৃষ্ণ একটু হেসে উত্তর দিলেন, “কর্ণ, আমি আপনাকে যা বললাম তা বোধহয় আপনি গ্রাহ্য করলেন না এবং আমার দেওয়া রাজ্যও আপনি শাসন করতে চান না। তবে আপনি জেনে রাখুন, এই যুদ্ধে পান্ডবদেরই জয় হবে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আপনি এখন গিয়ে ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপকে বলুন, এখন সুখকর অগ্রহায়ণ মাস এসেছে। এসময় ঘাস ও কাঠ সহজে পাওয়া যায়। ধান প্রভৃতি শস্য ও ফল ধরেছে, পথে-ঘাটে কাদা নেই, পানীয় জল সুস্বাদু হয়েছে এবং এ সময় গরম বা শীত কোনোটাই বেশি নয়। আজ থেকে সাতদিন পরে অমাবস্যা তিথিতেই যুদ্ধ আরম্ভ হোক, কারণ অমাবস্যার দেবতা যুদ্ধ-নিপুণ দেবরাজ ইন্দ্র। আর যুদ্ধের জন্য যে যে রাজারা আসবেন, তাঁদের সবাইকে আপনি বলবেন যে, তাঁদের যা ইচ্ছা, আমি অবশ্যই সেই কাজ করব। দুর্যোধনের পক্ষের সব রাজা ও রাজপুত্রেরা অস্ত্রের আঘাতে প্রাণত্যাগ করে স্বর্গলাভ করবেন।”

কৃষ্ণের এই কথা শোনার পর কর্ণ বললেন, “বাসুদেব! সারা পৃথিবী যে ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে তা আমি জানি। তাহলে আপনি কেন আমাকে রাজ্যের লোভ দেখাচ্ছেন? রাজা দুর্যোধন, দুঃশাসন, শকুনি এবং আমি, এই চারজনই সেই ধ্বংসের কারণ। পান্ডব ও কৌরবদের মধ্যের এই যুদ্ধে পৃথিবীর প্রায় সকল ক্ষত্রিয়ের বীরগতি লাভ হবে। আমি এখন অনেক খারাপ স্বপ্ন, খারাপ লক্ষণ এবং ভীষণ উৎপাত দেখতে পাচ্ছি। সেই লক্ষণগুলি যেন দুর্যোধনের হার এবং যুধিষ্ঠিরের জয় নিশ্চিত করছে। চাঁদের কলঙ্ক উল্টে গিয়েছে, বারবার ভূমিকম্প ও উল্কাপাত হচ্ছে। হাতিরা বিকৃত শব্দ করছে, ঘোড়াগুলির চোখ থেকে জল পড়ছে। তারা ভালো করে ঘাস খাচ্ছে না বা জলপান করছে না। জ্ঞানীরা বলেন, এইসব লক্ষণ থেকে প্রাণীদের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। অল্প পরিমাণে খেলেও মানুষ ও পশুদের প্রচুর বিষ্ঠা দেখা যাচ্ছে। এই সবই দুর্যোধনের পরাজয়ের লক্ষণ। পান্ডবদের কাছ থেকে আসা লোকেরা বলে, পান্ডবদের পশুদের আনন্দিত বলে মনে হয় এবং তাঁদের দক্ষিণদিক দিয়ে হরিণেরা চরে, এইই তাঁদের জয়ের লক্ষণ। আর দুর্যোধনের বামদিক দিয়ে হরিণের দল যাওয়া-আসা করে। তা দুর্যোধনের পরাজয়ের লক্ষণ। ময়ূর, চাতক, হাঁস, সারস, চকোর প্রভৃতি শুভ পাখিগুলি পান্ডবদের অনুসরণ করে। আর চিল, শকুন, রাক্ষসের ছায়া, চিতাবাঘ, মৌমাছি প্রভৃতিরা কৌরবদের আশপাশে ঘোরে। দুর্যোধনের সৈন্যদলের মধ্যে ভেরি বাজালেও শব্দ হয়না, পান্ডবদের ঢাকগুলি অল্প বাজালেও জোরে আওয়াজ হয়। সকালে ও সন্ধ্যায় শেয়ালেরা একটানা চিৎকার করে, তা পরাজয়ের লক্ষণ। একটি ডানা, একটি চোখ, একটি পা বিশিষ্ট কতগুলি পাখি ভয়ঙ্কর চিৎকার করে, তা পরাজয়ের লক্ষণ। গলার রং কালো, পায়ের রং লাল ভয়ানক কতগুলি পাখি সন্ধ্যাবেলায় পশ্চিমদিকে উড়ে যায়, তাও পরাজয়ের লক্ষণ। দুর্যোধন এবং তাঁর ভাইয়েরা প্রথমে ব্রাহ্মণের উপর, তারপর গুরুজনদের উপর এবং তারপর চাকরদের উপর রাগ করেন, তাও পরাজয়ের লক্ষণ।

“আমি স্বপ্নে দেখেছি, যুধিষ্ঠির তাঁর ভাইদের সঙ্গে হাজারটি স্তম্ভবিশিষ্ট প্রাসাদে বাস করছেন। তাঁদের পোশাক সাদা এবং আসনও সাদা। আমি দেখেছি আপনি রক্তাক্ত পৃথিবীটাকে ধরে ছুঁড়ে দিচ্ছেন। আরো দেখেছি, যুধিষ্ঠির হাড়ের রাশির উপর বসে সোনার থালায় ঘি ও পায়েস খাচ্ছেন। যুধিষ্ঠির যেন আপনার দেওয়া পৃথিবীকে গ্রাস করছেন। তাই দেখে আমি বুঝেছি যুধিষ্ঠিরই এই পৃথিবী ভোগ করবেন। আরো দেখেছি, ভীম গদা হাতে উঁচু পর্বতে উঠে পৃথিবীকে গ্রাস করছেন। অর্জুন গান্ডীব হাতে নিয়ে আপনার সঙ্গে সাদা হাতিতে চেপে চলেছেন। এর মানে আপনারা নিশ্চয়ই কৌরবদের হারিয়ে দেবেন। আমি দেখেছি নকুল, সহদেব, সাত্যকি সুন্দর পোশাক ও অলঙ্কার পড়ে সুন্দর রথে চেপে চলেছেন। আমি কৌরবপক্ষের অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা – শুধু এই তিনজনের পরনে সাদা উত্তরীয় দেখেছি। বাকি সব রাজাদের পরনে ছিল লাল উত্তরীয়। আরো দেখেছি, ভীষ্ম ও দ্রোণ যেন আমার আর দুর্যোধনের সঙ্গে উটে টানা রথে চেপে দক্ষিণদিকে চলেছেন। আর অল্পদিনের মধ্যেই আমরা সবাই নিশ্চয়ই যমালয়ে যাব।”

এইসব কথা শুনে কৃষ্ণ বললেন, “কর্ণ! পৃথিবীর ধ্বংসের সময় এসে গেছে। আমার উপদেশগুলি আপনার মনে ধরল না, কারণ মৃত্যুর সময় এলে মানুষের মন থেকে দুর্নীতি দূরে চলে যায় না।” কর্ণ বললেন, “বাসুদেব! বেঁচে থেকে কি আর যুদ্ধ শেষের পর আপনাকে দেখতে পাব? যদি না পাই, তবে স্বর্গে যাওয়ার পরই আপনার সঙ্গে দেখা হবে।” এই বলে কর্ণ কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে চলে গেলেন। কৃষ্ণও সারথি দারুককে রথ চালাতে আদেশ করলেন। সাত্যকির রথ পিছনে আসতে লাগল আর এভাবেই শেষ হল কৃষ্ণ ও কর্ণের কথোপকথন ।

তথ্যসূত্র


  1.  ‘মহাভারত’,কালীপ্রসন্ন সিংহ,  উদ্যোগপর্ব, অধ্যায় ১৩৮-১৪০, পৃষ্ঠা ২৪৮-২৫৩
  2. ‘মহাভারতের একশোটি দুর্লভ মুহূর্ত’, ধীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, দ্বিতীয় মুদ্রণ, কৃষ্ণ-কর্ণ সংবাদ, পৃষ্ঠা ৩৭৬-৩৮১

আপনার মতামত জানান