বর্ধমানের ১০৮ শিবমন্দির ভ্রমণ

বর্ধমানের ১০৮ শিবমন্দির ভ্রমণ

পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থানই সুপ্রাচীন মন্দির স্থাপত্যের কারণে বিখ্যাত। ইতিহাসে এক এক রাজা বা এক এক শাসক তাঁর রাজত্বকালে নিজের কীর্তি স্থাপনের জন্য সমগ্র বাংলা জুড়েই বিভিন্ন স্থানে মন্দির, মসজিদ নির্মাণ করেছেন আর প্রাচীন বাংলার টেরাকোটার মন্দিরের ঐতিহ্য-খ্যাতি ভারত বিখ্যাত। তেমনই পশ্চিমবঙ্গের একটি ঐতিহ্যবাহী মন্দির স্থাপত্যের নিদর্শন বর্ধমানের ১০৮ শিবমন্দির। আজ থেকে দুশো বছর আগে বিশেষ জ্যামিতিক পদ্ধতিতে নির্মিত এই ১০৮ শিবমন্দির আজও বাংলার ঐতিহাসিক নবাবদের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে অক্ষত আছে এবং এটি বাঙালিদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় এক পর্যটনক্ষেত্র। মূলত পূর্ব বর্ধমানে দুটি ১০৮ শিবমন্দিরের মধ্যে অন্যতম হল বর্ধমানের ১০৮ শিবমন্দির।

পূর্ব বর্ধমান জেলার বর্ধমান শহরে নবাবহাট বাসস্ট্যান্ডের কাছেই এই ১০৮ শিবমন্দির অবস্থিত। বর্ধমান স্টেশন থেকে সিউড়ি রোড ধরে কিছুদূর এগোলেই এই শিবমন্দিরের দেখা মিলবে ।

পশ্চিমবঙ্গের সবথেকে ঐতিহ্যবাহী জেলা হল বর্ধমান। এর ইতিহাসে ছড়িয়ে আছে কত রাজা-রাজড়াদের কাহিনী। বিশেষত এই জেলাকে শিবঠাকুরের আরাধনার উৎকৃষ্ট স্থল বলা হয়। বর্ধমানে শিব মন্দির রয়েছেও প্রচুর। মুঘল আমলে বর্ধমান শরিফাবাদ নামে পরিচিত ছিল। ১৭৮৮ সালে বর্ধমানের মহারানি বিষ্ণুকুমারী দেবী প্রথম নবাবহাটে একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাসের ভিত্তিতে বর্ধমানের নবাবহাটেই প্রথম ১০৮ শিবমন্দির স্থাপিত হয়। প্রাচীনকালে নবাবহাটে এক প্রবল মন্বন্তরে সমস্ত গ্রাম জনশূন্য হয়ে যায়। বর্ধমানের মহারাজা তিলকচাঁদও এই দুর্ভিক্ষে মারা গেলে তাঁর নাবালক পুত্রকে নিয়ে রানি বিষ্ণুকুমারী দেবী কিছুদিন বর্ধমানের সিংহাসনে আসীন ছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গে বিষ্ণুকুমারী দেবীর সংঘাত বাধে এবং এই বিরোধ সামাল দিয়েও নিরুপদ্রবে তিনি বর্ধমানের দুর্ভিক্ষকে নিয়ন্ত্রণে আনেন, অগণিত মানুষের প্রাণ বাঁচান। ১৭৮৮ সালে মহারাজা তেজপালের বদান্যতায় ১০৮ শিবমন্দির নির্মাণ শুরু হয়। ১৭৯০ সালে এই মন্দিরের নির্মাণকার্য শেষ হয়। একসময় রানির নির্মিত এই মন্দিরগুলি জীর্ণ হয়ে পড়ায় বিড়লা জনকল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে মন্দিরের সংস্কার সাধন করা হয়।

বর্ধমানের ১০৮ শিবমন্দির দেখতে গেলে ট্রেনে করে নামতে হবে বর্ধমান স্টেশনে এবং সেখান থেকে গাড়ি, টোটো বা অটো ভাড়া করে জি. টি. রোড ধরে কিছুদূর এগিয়ে সিউড়ি রোডে আসতে হবে। এই সিউড়ি রোড ধরে কিছুটা এগোলেই পাওয়া যাবে নবাবহাটের মন্দিরটি।

১০৮ শিবমন্দিরের আশেপাশে সেভাবে থাকার জায়গা বিশেষ নেই। অনেকাংশে পর্যটকরা একদিনের ট্যুরেই এই মন্দির ঘুরতে পছন্দ করেন এবং সময়ের হিসেবে একদিনে ঘুরে আসার সবথেকে আদর্শ জায়গাগুলির মধ্যে এটিও অন্যতম। তবে একান্তই থাকার দরকার হলে বর্ধমান স্টেশনের কাছে কিছু হোটেল আছে সেগুলোতে থাকতে পারেন।

বর্ধমানের ১০৮ শিবমন্দিরের প্রধান প্রবেশদ্বারের পাশে কৃত্রিমভাবে একটি পাহাড়ের আকৃতি তৈরি করা হয়েছে। এই পাহাড়ের উপরই রয়েছে শিব-পার্বতী এবং হনুমানের মূর্তি। এখানের শিবমন্দিরগুলি দুটি সারিতে পৃথক পৃথকভাবে সারিবদ্ধ করে তৈরি করা হয়েছে। মোটামুটিভাবে মন্দিরগুলি পনেরো ফুট উঁচু। বাংলার প্রাচীন আটচালার শিল্পরীতিতে তৈরি হয়েছে নবাবহাটের মন্দিরগুলি। কোনও কোনও মন্দিরে দরজা নেই, কিন্তু বেশিরভাগ মন্দিরেই অল্প-বিস্তর টেরাকোটার কাজ রয়েছে। যদিও নবাবহাটে মোট ১০৯টি মন্দির আছে – দুটি সারিতে মোট ১০৮টি এবং একটি মন্দির একেবারে আলাদা রয়েছে। মন্দির চত্বরের অফিসে ১০৮টি পিতলের ঘন্টা রাখা আছে। অনেকে মন্দির দর্শন করে ফেরার সময় এই পিতলের ঘন্টাগুলি বাজান। ভক্তদের বিশ্বাস এখানে ঘন্টা বাজালে মনস্কামনা পূরণ হয়। প্রতিটি মন্দিরের ভিতরেই রয়েছে কালো কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ। তাছাড়া শিবলিঙ্গের সঙ্গেই দেখা যায় গৌরীপট্ট।

শিবমন্দিরের পিছনে পূর্বদিকে একটি জলাশয় রয়েছে। কিছুটা লম্বা আকারের এই জলাশয়ের পাড় বাঁধানো এবং জলটা কিছুটা ঘোলা। মন্দিরে পুজো দিতে চাইলে মন্দির সংলগ্ন বেলগাছের পাতা দিয়েই শিবকে অর্পণ করতে পারেন। মহাশিবরাত্রি কিংবা চড়ক উপলক্ষ্যে এখানে যেহেতু প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়, তাই সেই সময় এলে ভিড়ের কারণে ভালোভাবে ঘোরা যাবে না। ফলে শিবপূজার দিনগুলি বাদ দিয়ে এলে সমগ্র মন্দির চত্বরটা ঘুরে দেখার অবকাশ পাওয়া যায়। মূল মন্দিরে প্রবেশের আগে জুতো রাখার একটা সুন্দর লোহার তাক করা আছে। সেখানে জুতো খুলে তবেই মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। জুতো রাখার জন্য খুব সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে একটি কুপন পাওয়া যায়। মন্দির দেখা শেষ করে এসে জুতো রাখার কাউন্টারে কুপনটি জমা দিলে আবার জুতোগুলি ফেরত দেওয়া হয়। জুতো খুলে ঢোকার সময় সামনেই একটি জলের কল রয়েছে, সেখানে হাত-মুখ চাইলে ধুয়ে নিতে পারেন। মন্দিরের ভিতরে ছবি তোলার উপর কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই, কিন্তু যেখানে সেখানে বসার উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গণে অত্যন্ত সচেতন থাকতে হবে আচার-ব্যবহারে। নীরবতা বজায় রাখাই শ্রেয়।

বছরের যে কোনও সময় নবাবহাটের ১০৮ শিবমন্দির ভ্রমণে আসা যায়। তবে মন্দির সবসময় খোলা থাকে না। সকাল আটটা থেকে দুপুর একটা এবং দুপুর তিনটে থেকে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে। এই সময়ের মধ্যেই মন্দির দর্শন করা যায়।

ফেরবার সময় বর্ধমান স্টেশনের কাছের দোকানগুলো থেকে বর্ধমানের মিহিদানা আর সীতাভোগ কিনে নিয়ে যেতে পারেন। এখানের মিহিদানা আর সীতাভোগ খুবই বিখ্যাত


ট্রিপ ট্রিপস

  • কীভাবে যাবেন – বর্ধমানের ১০৮ শিবমন্দির দেখার জন্য ট্রেনে বর্ধমান স্টেশনে নেমে অটো, টোটো বা গাড়ি ভাড়া করে যেতে হবে। নিজের গাড়ি থাকলে বর্ধমান স্টেশন পেরিয়ে জি. টি. রোড এবং তারপর ডানদিকে সিউড়ি রোডে কিছুটা গেলেই পাওয়া যাবে এই ১০৮ শিবমন্দির।  
  • কোথায় থাকবেন – এখানে আশেপাশে কোথাও বিশেষ থাকার জায়গা নেই। তবে একান্তই থাকার দরকার হলে বর্ধমান স্টেশনের কাছে কিছু হোটেল আছে সেগুলোতে থাকতে পারেন।
  • কী দেখবেন – নবাবহাটের ঐতিহ্যবাহী ১০৮ শিবমন্দির।
  • কখন যাবেন – বছরের যে কোনও সময় আসা গেলেও মন্দির প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা এবং দুপুর ৩টে থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
  • সতর্কতা –        
    • মন্দির প্রাঙ্গণে যথাসম্ভব নীরবতা বজায় রাখাই শ্রেয়।
    • মন্দিরের ভিতরে কোথাও বসা উচিত নয়।
    • ছবি তোলার ক্ষেত্রে কোথাও নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও নিয়মবিধির বিজ্ঞাপন দেখে নেওয়া দরকার।
    • মন্দির প্রাঙ্গণে জুতো পড়ে থাকা যাবে না, নির্দিষ্ট স্থানে জুতো খুলে তবেই প্রবেশ করা উচিত।

আপনার মতামত জানান