সতীপীঠ ভদ্রকালী

সতীপীঠ ভদ্রকালী

ভদ্রকালী সতীপীঠটি হরিয়ানার কুরুক্ষেত্র জেলার থানেশ্বরে অবস্থিত। এটি একান্ন সতীপীঠের একটি পীঠ। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে সতীপীঠ ভদ্রকালী তে সতীর ডান পায়ের গাঁটের হাড় বা গুল্ফ পড়েছিল। মতান্তরে এখানে দেবীর ডান পায়ের গোড়ালি পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী হলেন ভদ্রকালী এবং ভৈরব হলেন স্থাণু।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। বলা হয় সতীর ডান পায়ের গোড়ালি অথবা গাঁটের হাড় পড়ে এই সতীপীঠটি গড়ে উঠেছে।

প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে প্রাচীনকালে এই জায়গার নাম ছিল সমন্তপঞ্চক। এখানে রাজত্ব করতেন সম্বরণ নামে এক রাজা। সূর্যদেবের মেয়ে তপতী ছিলেন তাঁর রাণী। মহারাজ সম্বরণের ছেলের নাম ছিল কুরু। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক এবং প্রজাপালক রাজা। এই স্থানকে পুণ্যক্ষেত্র করার উদ্দেশ্য নিয়ে মহারাজ কুরু লাঙ্গল দিয়ে এখানকার মাটি চাষ করতে শুরু করেন। তাঁর ধৈর্য্য ও নিষ্ঠা থেকে দেবরাজ ইন্দ্র খুব খুশি হন এবং কুরুরাজকে বর দেন যে, তাঁর নামানুসারে এই স্থানের নাম হবে ‘কুরুক্ষেত্র’ এবং এখানে কোন ব্যক্তির মৃত্যু হলে সে অবশ্যই মোক্ষলাভ করবে। জানা যায়, সেই কারণে এই জায়গাতেই পান্ডব ও কৌরবদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল, যাতে যুদ্ধে নিহত সব যোদ্ধাদের মোক্ষলাভ হয়। আরও শোনা যায়, যুদ্ধের আগে শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে এখানেই দেবী ভদ্রকালীর পূজা করেছিলেন অর্জুন। মানত করেছিলেন, যুদ্ধে পান্ডবরা জয়ী হলে ঘোড়া দিয়ে দেবীর পূজা দেবেন। সেই থেকে এখন ভক্তরা দেবীর কাছে সোনা, রুপো অথবা মাটির ঘোড়া মানসিক করে। আরও একটি জনশ্রুতি অনুসারে, শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরাম এখানে তাঁদের মাথা মুড়িয়েছিলেন। এখন অনেক ভক্তই এখানে তাঁদের ছেলেমেয়েদের মাথা মুড়িয়ে নিয়ে আসেন। 

ঐতিহাসিকদের মত অনুসারে, মহান সম্রাট হর্ষবর্ধনের রাজধানী ছিল থানেশ্বর। এই থানেশ্বর শব্দটি থেকেই দেবী ভদ্রকালীর ভৈরবের নাম হয়েছে ‘স্থাণু’। ভদ্রকালী মন্দিরটি আকারে বিশাল। মন্দিরের ভিতরে একটি লোহার জালে ঢাকা কুয়ো আছে। সেই কুয়োর উপরে আছে একটি বিরাট পদ্ম। পদ্মটির উপরে রাখা আছে শ্বেতপাথরে নির্মিত একটি পা। মনে করা হয়, এটিই আসলে দেবীর অঙ্গ। সারা মন্দিরে অসংখ্য ঘণ্টা ঝুলে রয়েছে। কুয়োটির রেলিংয়ের গায়ে ভক্তেরা আছাড় মেরে নারকেল ফাটিয়ে দেবীকে নিবেদন করেন। অনেকে মানত করে ঢিল বেঁধে দিয়ে যান।

দেবী সতী এখানে কালীরূপে পূজিতা হন। দেবী করালবদনা, চতুর্ভুজা, মুণ্ডমালিনী। দুই ডান হাতে বরাভয় মুদ্রা এবং দুই বাম হাতে খড়্গ ও অসুরের কাটা মাথা। দেবীর পরনে শাড়ি, মাথায় মুকুট এবং আরো নানা অলঙ্কার। এখানে দেবী ভদ্রকালীর সঙ্গে দেবী সরস্বতী, দেবী গায়ত্রী, রাম-সীতা, নারায়ণ, বিষ্ণুর দশটি অবতার, শ্রীহনুমান, গণেশ প্রভৃতি দেবতারাও পূজিত হন। দেবী সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে ভগবান শিবের নৃত্যরত একটি মূর্তিও এখানে আছে।

প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকেন। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। সতীপীঠ ভদ্রকালী তে দেবী হলেন ‘ভদ্রকালী’ এবং ভৈরব হলেন ‘স্থাণু’। তবে ভিন্ন মতও পাওয়া যায়। ভারতচন্দ্র তাঁর অন্নদামঙ্গলে এই সতীপীঠের দেবী হিসেবে বিমলার নাম বলেছেন। অন্যদিকে, শিবচরিত মতে, এই সতীপীঠের দেবী হলেন সাবিত্রী। আর ভৈরব হলেন সংবর্ত। আবার ব্রহ্মযামল তন্ত্রমতে, কুরুক্ষেত্রে অধিষ্ঠিত দেবী হলেন ভদ্রকালী।

এই মন্দিরে সারাবছরই অনেক দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তেরা পুজো দিতে আসেন। তবে আশ্বিন ও চৈত্র মাসের নবরাত্রিমহাশিবরাত্রি এখানে খুব ধুমধাম করে পালিত হয়। এছাড়াও রাখি পূর্ণিমার দিন, ভক্তেরা মায়ের কাছে তাঁদের সুরক্ষা চেয়ে রাখি বাঁধেন। মনে করা হয়, এর ফলে দেবী ভদ্রকালী ভক্তদের সব বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।

আপনার মতামত জানান