বারাসাত

বারাসাত

পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত উত্তর ২৪ পরগণা জেলার একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ ইতিহাস বিজড়িত জনপদ হল বারাসাত (Barasat)। এই জনপদ বারাসাত পৌরসভার অন্তর্গত।

২২ ডিগ্রি ২৩ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮ ডিগ্রি ৩৫ মিনিট পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত বারাসাত জনপদটি একটি গাঙ্গেয় ব-বদ্বীপের অংশবিশেষ। সমুদ্রতল থেকে গড়ে ৫ মিটার উঁচু বারাসাতের পূর্বদিকে রয়েছে কাজিপাড়া, পশ্চিমে নবপল্লি ও হৃদয়পুর, উত্তরে নোয়াপাড়া এবং দক্ষিণে রয়েছে সুকান্তনগর। শিয়ালদা-বনগাঁ রেলপথের দ্বারা এই শহর যুক্ত থাকায় যাতায়াত ব্যবস্থা সুগম হয়েছে। বারাসাত জংশন থেকে ২৩ কি.মি দূরে শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশন এবং মাত্র ১১ কি.মি দূরত্বে রয়েছে নেতাজি সুভাষ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।

‘আইন-ই-আকবরী’তে যখন খুঁজে পাওয়া যায় বারাসাতের নাম, তখন নিশ্চিন্তে বলা যায় প্রাচীন এই জনপদের নামকরণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। রহস্য অনেক, মতান্তরও অনেক। কারো কারো মতে, এই অঞ্চলে সিরাজদৌল্লাহ্‌র সময়কালীন বিখ্যাত সেই জগৎ শেঠের পরিবারের বারোজন সদস্য এই জনপদে থাকতেন বলে এর নাম ছিল ‘বারো শেঠ’। এই ‘বারো শেঠ’ কালের নিয়মে বিবর্তিত হতে হতে ‘বারাসাত’ নামে পরিণত হয়েছে। আবার অনেকের মতে, ফার্সি শব্দ বারাসাতকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় ‘বার’ অর্থাৎ জনপদ আর ‘সত’ অর্থাৎ সাত। প্রাচীনকালে মোট সাতটি জনপদ নিয়ে এই বারাসাত গড়ে উঠেছে বলে জানা যায়। সেই জনপদগুলি হল – শ্রীধরপুর, হৃদয়পুর, বনমালিপুর, প্রসাদপুর, চন্নপুর এবং নিশ্চিন্দিপুর। মোটামুটিভাবে ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ অনুযায়ী বলা যেতে পারে এই জনপদের নামকরণটি আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীতে ‘বারাসাত’ দেওয়া হয়েছিল। তবে জেলার বা জনপদের ইতিহাস-বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এ নিয়ে বিস্তর মতানৈক্য রয়েছে।

মূলত ব্রিটিশ আমলেই বারাসাতের শ্রীবৃদ্ধি ঘটলেও এর ইতিহাসের যাত্রাপথ অনেককাল আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে। গুপ্তযুগের নথিতে বারাসাতের উল্লেখ পাওয়া গেছে। তারপর মোগলদের আমলে ‘আইন-ই-আকবরী’ বইতেও বারাসাতের উল্লেখ রয়েছে। এমনকি এই বই থেকে জানা যায় ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের ব্রাহ্মণ সেনাপতি শঙ্কর চক্রবর্তী থাকতেন এই বারাসাতেই। এদিকে মোগল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহের সঙ্গে প্রতাপাদিত্যের যুদ্ধ বাধে এবং প্রতাপাদিত্য পরাজিত হলে প্রথমে তাঁর সেনাপতি শঙ্কর চক্রবর্তীকে বন্দি করে মোগল বাহিনী। কিন্তু আকবরের স্ত্রী পরমা দয়াশীলা যোধাবাঈয়ের অনুরোধে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অধুনা বারাসাতের দক্ষিণপাড়ায় তাঁর বাড়িটি এখনো রয়েছে। বারাসাতের ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপূজা শঙ্কর চক্রবর্তীই চালু করেছিলেন। মোগল আমলেই জাহাঙ্গীরের শাসনকালে রামসুন্দর মিত্র নামে জনৈক বারাসাতবাসী আকবরের ভূমিরাজস্ব মন্ত্রী টোডরমলকে জমি-জরিপের কাজে সাহায্য করতেন এবং জানা যায় যে পরে তিনি ‘রায়রায়ন’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। অনেক আগে এই জনপদটি সুন্দরবনের ব-দ্বীপের অন্তর্ভুক্ত ছিল, জলে কুমির ডাঙায় বাঘের প্রবাদ পটভূমি বাস্তবিকই উপস্থিত ছিল বারাসাতে। কালের নিয়মে সেই জঙ্গলের দিনরাত্রি এখন কেটেছে। সুবর্ণবতী আর লাবণ্যবতী নামে দুটি প্রাচীন নদীর কথা জানা গেলেও তাদের সেই লাবণ্য আর নেই। বর্তমানে ‘সুঁটি’ আর ‘নোয়াই’ নামে পরিচিত বারাসাতের এই প্রাচীন নদীদুটি এখন মৃতপ্রায়। শোনা যায় এই সুবর্ণবতী নদীর ধারে জগদিঘাটায় একসময় ছিল রাজা প্রতাপাদিত্যের নৌ-বন্দর। প্রখ্যাত লেখিকা বাণী বসুর লেখা ‘খনামিহিরের ঢিবি’-র কথা অনেকেই জানেন। সেই খনামিহিরের ঢিবি অর্থাৎ চন্দ্রকেতুগড় প্রাচীনকালে বারাসাতের অনতিদূরেই অবস্থিত ছিল। ব্রিটিশ আমলে পালাবদল ঘটতে থাকে বারাসাতের ইতিহাসে। বারাসাতের উত্তরাংশে গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের সুরম্য দোতলা বাড়ি ছিল সেসময়। বারাসাতেই আশেপাশে ঐ সময়েই শুরু হয়ে যায় নীল চাষ। পশ্চিমদিকের কলপুকুরে ওলন্দাজেরা প্রথম নীল চাষ করা শুরু করলেও ইংরেজদের সময় পুরো বারাসাত মহকুমা ‘নীল জেলা’ নামে পরিচিত হয়। ১৭৭৯ সালে বারাসাতের কাছেই নীলগঞ্জে স্থাপিত হয়েছিল বাংলার প্রথম নীল-কারখানা আর এই নীলকর সাহেব, অত্যাচারী জমিদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন তিতুমির এই বারাসাতের মাটিতেই। নারকেলবাড়িয়ায় গড়ে তোলা তাঁর বাঁশের কেল্লা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। বারাসাত বিদ্রোহের ইতিহাস, তিতুমিরের বিদ্রোহ আর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের স্মৃতি সমগ্র জনপদকে আজও যেন মুড়ে রেখেছে।

বারাসাতের অন্তর্গত কাজিপাড়ার একটি পৃথক ইতিহাস রয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীতে পীর হজরত একদিল শাহ এখানে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে আসেন। ১৮৮৫ সালে কাজিপাড়া একদিল শাহ উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপিত হয় তাঁরই স্মৃতিতে। এখনও কাজিপাড়ায় পীর হজরত একদিল শাহের সমাধিটি অক্ষত আছে। নীলকর সাহেবদের রক্ষিতা চাঁপা আর ডালির নামে আজও বারাসাতের ‘চাঁপাডালি মোড়’ বিখ্যাত হয়ে আছে।

বারাসাতের শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারী-বেসরকারী বিদ্যালয়গুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাজ্য বোর্ড ছাড়াও এখানে দিল্লি বোর্ডের বহু ইংরেজি-মাধ্যম বিদ্যালয় রয়েছে। বারাসাত প্যারীচরণ সরকার গভর্নমেন্ট হাই স্কুল, বনমালীপুর প্রিয়নাথ ইন্সটিটিউশন (উ: মা:), বারাসাত গার্লস হাই স্কুল (উ: মা:), বারাসাত সত্যভারতী বিদ্যাপীঠ, বারাসাত ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল হাই স্কুল ইত্যাদি এখানকার বিখ্যাত সব বিদ্যালয়। সম্প্রতি ২০০৮ সালে বারাসাতে স্থাপিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় (West Bengal State University) যা বারাসাত বিশ্ববিদ্যালয় নামেও পরিচিত। উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে বারাসাত গভর্নমেন্ট কলেজ ছাড়াও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। ২০১৪ সালে বেসরকারী উদ্যোগে এখানে অ্যাডামাস বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় যেখানে প্রযুক্তিবিদ্যা, অর্থনীতি, আইন, বাণিজ্য, ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে এই জনপদের সাক্ষরতার হার ৭৭ শতাংশ যা কিনা দেশের মোট সাক্ষরতার হার অপেক্ষা অনেক বেশি।

বিখ্যাত সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উত্তর ২৪ পরগণার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন বারাসাতে কিছুদিন এসে অতিবাহিত করেছেন বলে জানা যায়। এছাড়াও আরেক ইংরেজ লেখক, এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য এবং ব্রিটিশ অফিসার ডেভিড হাগটন বারাসাত ক্যাডেট ইন্সটিটিউশনেই প্রথম শাসনভার লাভ করেন।

শঙ্কর চক্রবর্তীর প্রচলিত রীতি অনুসারে আজও বারাসাতে বর্ণাঢ্য আড়ম্বরপূর্ণ উপচারে দুর্গাপূজা হয়ে থাকে। নিঃসন্দেহে বলা যায় বারাসাতের দুর্গাপূজা উত্তর ২৪ পরগণা জেলার সবথেকে প্রাচীন পূজা। সেইসঙ্গে এখানকার ডাকাতে কালীর কথাও জনশ্রুতিতে খুবই বিখ্যাত। শোনা যায় রঘু ডাকাত তার দল নিয়ে এখান থেকে দেড়-দুই কি.মি দূরে নদীর ধারে এক ভাঙা মন্দিরে ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে মা কালীর সাধনা করতেন। সেই স্মৃতিতে আজও ভগ্নপ্রায় এই মন্দিরে মা কালীরূপে বটগাছকে পুজো করা হয়, উৎসব উপলক্ষে বটগাছের সামনেই মোমবাতি-ধূপ-ধুনো জ্বালানো হয়। বারাসাতের এই ডাকাতে কালী নিয়েও একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। লোকমুখে শোনা যায় প্রচণ্ড রাগে একদিন রঘু ডাকাত নাকি মায়ের মূর্তি তলোয়ারের এক কোপে ভেঙে দিয়েছিলেন আর সেই থেকে মা কালীর ভাঙা মূর্তিতেই পূজা হতো এখানে। তবে আগেকার সেই অষ্টধাতুর ভাঙা কালীমূর্তিটিও এখন আর নেই, চুরি হয়ে গেছে। এছাড়া কাজিপাড়ায় অলৌকিক শক্তিধর পীর একদিল শাহের স্মৃতিতে এখানকার এক মসজিদে প্রতি বছর মেলা বসে। অসংখ্য মানুষের সমাগম ঘটে এই মেলায়।

হস্তশিল্পের বিশেষ অভিনবত্ব না থাকলেও কিছু কিছু স্বনির্ভর গোষ্ঠী এখানে টেরাকোটার কাজ, কাঠের পুতুল নির্মাণের কাজ করে থাকে। বারাসাতের হৃদয়পুরে ‘অশেষ সুইটস’-এর কালাকাঁদ, সরপুরিয়া, কালোজাম, জলভরা সন্দেশ, ছানার পায়েস আর মিষ্টি দইয়ের সুখ্যাতিও অশেষ। বারাসাতের এই ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির দোকান সেই ১৯৭৯ সাল থেকে বিখ্যাত কালীপুজো দেখতে আসা মানুষদের রসনাতৃপ্তি ঘটায়।

একদিকে কালী মন্দির, দুর্গাপুজোর প্রাচীন ঐতিহ্যের পাশে একদিল শাহের স্কুল, একদিল শাহের মসজিদ সব মিলিয়ে বারাসাতের সংস্কৃতিতে এক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা লক্ষ করা যায়। এটাই যেন বাংলার সনাতন সংস্কৃতির অনন্য চেহারা।

বারাসাতে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, হাতিপুকুর পার্ক আর হেস্টিংস হাউজ সবথেকে বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানের মধ্যে পড়ে। হেস্টিংস হাউজ আসলে সেই বিখ্যাত ওয়ারেন হেস্টিংসের সুরম্য বাড়ি। এছাড়া কাছেই রয়েছে ঐতিহাসিক চন্দ্রকেতুগড়। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন এখানকার সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে যা ঐতিহাসিক দিক থেকে অপরিসীম গুরুত্ব সম্পন্ন। খনামিহিরের ঢিবি নামে পরিচিত অঞ্চলটিও এখানে দেখে আসা যায়।

খুব ছোট্ট একটা জনপদ হলেও ঐতিহাসিক গুরুত্বের বিচারে বারাসাত আজও সমানভাবে জনপ্রিয়। কলকাতার উপকণ্ঠের এই মফস্বলেও নাগরিক আঁচড় পড়তে শুরু করেছে। যুগের হাওয়া থেকে বারাসাতের হেরিটেজ আর ইতিহাসের নিদর্শনগুলি, অবহেলিত জনশ্রুতিগুলি যেন না হারিয়ে যায়!

2 comments

আপনার মতামত জানান