বক রাক্ষস

বক রাক্ষস

পাণ্ডবদের বনবাসকালে তাঁরা যখন এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে ছিলেন, তখন একদিন সেই ব্রাহ্মণের কান্না শুনে তাঁরা জানতে পারেন সেখানে নাকি বক রাক্ষস বলে একজন থাকে যার প্রতিদিন একটি মানুষ খাদ্য হিসাবে চাই। ভীমের সঙ্গে সংঘাতে প্রাণ যায় তার।

হিড়িম্বা আর ভীমের সন্তান ঘটোৎকচ জন্ম নেওয়ার পর ছেলেকে হিড়িম্বার কাছে রেখেই ভীমেরা এগিয়ে চললেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। একসময় তাদের সাথে দেখা হল তাদের পিতামহ ব্যাসের। তিনি তাদের এক ব্রাহ্মণের গৃহে ছদ্মবেশে রেখে আসেন। যেখানে রেখে আসেন, সেই নগরের নাম একচক্রা নগর। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী জায়গাটি পশ্চিমবঙ্গে । অন্যমতে জায়গাটি মহারাষ্ট্রে,আবার কেউ বলে এটা উত্তরপ্রদেশে, তো কেউ বলে কর্ণাটকে। সে যেখানেই হোক না কেন পাণ্ডবেরা তাদের বনবাসে সেইখানে বাস করতে শুরু করেন। তাঁরা ভিক্ষা করে দিনযাপন করতেন। ভিক্ষার খাবার এলে দুইভাগে তাকে ভাগ করা হত। একভাগ পেত ভীম, অন্যভাগ বাকিরা। এইরকম একদিন যুধিষ্ঠিররা ভিক্ষা করতে গেছেন এবং ঘরে আছে শুধু মা কুন্তী এবং ভীম। তাঁরা যে ব্রাহ্মণের ঘরে ছিলেন, সেখান থেকে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন কুন্তী। সেখানে গিয়ে তিনি দেখলেন ব্রাহ্মণের পরিবারের সকলে কান্নাকাটি করছে। ব্রাহ্মণ বলছে সে মরবে। তার স্ত্রী বলছে সে মরবে কেননা ব্রাহ্মণ যদি মরতে যায় তাহলে পরিবারকে কে দেখবে? উপরন্তু স্বামী বিনা নারীকে সকলে কামনা করে এবং তাকে বিপথে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু স্বামী, পুত্র কন্যা রেখে সে মারা গেলে তার বরং পুণ্য হবে। তখন তার কন্যা বলেন তাকে তো একদিন বিয়ে দিয়ে দেবে এবং তার ফলে তাকে এই বাড়ি ছাড়তেই হবে। তার থেকে বরং এখন এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো। কুন্তী  কিছুই বুঝতে পারছিলেন না, কেন  এরা সকলে মরবার কথা বলছে। অবশেষে ব্রাহ্মণের ছেলে বলল, “তোমরা চিন্তা কোরো না। আমি একাই এই ঘাস দিয়ে ওই বক রাক্ষস কে মেরে আসব।”

এবার কুন্তীর কিছুটা বোধগম্য হল। এখানে কোন রাক্ষসের উপদ্রব হয়েছে। কিন্তু কে সে কেনই বা এদের মারবে সেটা জানা নেই কুন্তীর। কিন্তু তিনি ব্রাহ্মণদের সাহায্য করতে চান। সেই ইচ্ছাতেই এগিয়ে এসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ” আমি  আপনাদের কান্নার আওয়াজ শুনে এখানে এলাম। আমি কোনভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি?”
ব্রাহ্মণ আরও কেঁদে ওঠে, “আমাদের কে সাহায্য করবে! এী নগরের রাজাই যেখানে সাহায্য করতে পারে না,  আর কে সাহায্য করবে বলুন!”
“কিন্তু কি হয়েছে যদি সেটা বলেন “,কুন্তী বলেন।
তখন ব্রাহ্মণ বলতে শুরু করেন, “এই একচক্রা নগরে বক নামে এক রাক্ষস থাকে। সেই এখানের মালিক। এখানের রাজাও তাকে কিছু করতে পারে না, বরং তাকে ভয় পায়। বক রাক্ষসই আমাদের রক্ষা করে। বদলে তাকে প্রতিদিন একজন লোকসমেত খাবার এবং দুটি মোষ পাঠাতে হয়। শুধু খাবারই না, সে মোষসমেত ওই মানুষটাকেও খেয়ে ফেলে।”, বলেই ব্রাহ্মণ আবার কাঁদতে শুরু করল।, “আজ আমার যাবার পালা। আমাকে তার জন্য খাবার আর মোষ নিয়ে যেতে হবে। আমার এমন ক্ষমতাও নেই যে আমি আমার বা আমার পরিবারের অন্য কারও বদলে একজন অন্য মানুষ কিনে নিই। তাই ভাবছি আমরা সকলেই তার খাবার হওয়ার জন্য তার কাছে যাবো।”
কুন্তী তাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, “আমি যদি বলি আমার পাঁচপুত্রের একজনকে তার কাছে পাঠাবো”
কিন্তু ব্রাহ্মণ বাধা দিয়ে বলল, “এ কি বলছেন আপনি? আপনারা আমাদের অতিথি। আপনাদের আমি কিভাবে এমন বিপদে ফেলব? আমার জন্য আপনার ছেলে কেন প্রাণ দেবে?”
কিন্তু কুন্তী তো জানে সে কার কথা বলছে। নিজের দ্বিতীয় ছেলে ভীমের ওপর তার অগাধ বিশ্বাস। তাছাড়া এই কিছুদিন আগেই ভীম হিড়িম্ব রাক্ষসকে বধ করেছে। সে বলল, “আপনারা কিছু চিন্তা করবেন না। আমার ছেলেকে প্রাণ হারাতে হবে না। সে এক বীরপুরুষ এবং অনেক মন্ত্র জানে। সে রাক্ষসের খাবার তাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। আর রাক্ষস আপনাদের ভবিষ্যতে জ্বালাতন করবে না। কিন্তু আমার ছেলের কথা কাউকে জানাবেন না দয়া করে। নাহলে ওর থেকে মন্ত্র শেখার জন্য লোকজন আমাদের অতিষ্ঠ করে তুলবে।”
ব্রাহ্মণ এবং তার পরিবার এই কথা  শুনে খুব সন্তুষ্ট হল।

কিন্তু যুধিষ্ঠির যখন ফিরে এসে এই কথা শুনলেন, তিনি একেবারেই সন্তুষ্ট হলেন না, খুবই রুষ্ট হলেন। মাকে বললেন, “এ তুমি কি করলে মা! যার ভরসায় রোজ আমরা ঘুমোতে যাই, যার ভয়ে দুর্যোধন-শকুনিদের ঘুম উড়ে গেছে, তুমি কিনা তাকে পাঠাচ্ছো রাক্ষসের কাছে? পরের ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের ছেলেকে মরতে পাঠাচ্ছো ?”
কুন্তী হাসলেন। ভীমের জন্মের  সময়ে কি হয়েছিল, তিনিই তো জানেন। তিনি শুধু বললেন, “ভীমের ওপর আমার ভরসা আছে। আর যাদের ঘরে থাকছি তাদের উপকার করবো না?”
যুধিষ্ঠির আর কিছু বললেন না।

পরের দিন সকাল সকাল ভীম খাবার দাবার নিয়ে যেখানে বক রাক্ষস থাকে সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। এসে রাক্ষসের নাম ধরে ডাকতে থাকলেন, তারপর রাক্ষসের জন্য আনা খাবার নিয়ে নিজেই খেতে বসে গেলেন। বক রাক্ষস যখন সেখানে এল, এই দৃশ্য দেখে তো তার চোখ কপালে উঠল। সাধারণত যারা আসে মৃত্যুভয়ে কাঁপতে থাকে।  এ কে, যে তার খাবার নিয়েই খেতে বসে গেছে! রাগে চিৎকার করে উঠল, “কে রে তুই? আমার সামনেই আমার খাবার নিয়ে খাচ্ছিস? এতো বড় সাহস!”
কিন্তু ভীম তার কথায় গ্রাহ্য করলেন না। তিনি খেয়ে চললেন। বক তার পিঠে জোরে আঘাত করল, তাতে ভীমের কিছুই হল না। এরপর খাওয়া শেষ করে উঠে ভীম তার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করল। বককে মাটিতে ফেলে ভীম তাকে বধ করল। বক রাক্ষসের চিৎকার শুনে তার আত্মীয় , বন্ধু বান্ধব সব রাক্ষস বেরিয়ে এল। বককে এইভাবে পড়ে থাকতে দেখে তারা খুব ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু ভীম তাদের আশ্বস্ত করে বলল, “তোমরা মানুষের হত্যা কোরো না। তাহলে তোমাদের কোন ক্ষতি হবে না।”
সঙ্গে তাদের ধমকিও দিয়ে বলল, “কিন্তু যদি সেই কথা ভুলে গিয়ে মানুষের হত্যা করা চালু করো, তাহলে তোমাদের হালও এর মতই হবে” এই বলে ভীম মাটিতে পড়ে থাকা বক রাক্ষসের দিকে দেখাল। তারা সকলে কথা দিল এরপর থেকে তারা আর মানুষ মারবে না। ভীম রাক্ষসের মৃতদেহ নগরের মুখে ফেলে রেখে চুপচাপ সেই ব্রাহ্মণের ঘরে ফিরে এল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই চারদিকে শোরগোল পড়ে গেল। কেউ নাকি বক রাক্ষসকে মেরে ফেলেছে। সবাইয়ের সাথে ব্রাহ্মণ আর তার পরিবারের লোকজনেরাও নগরে ঢোকার মুখে এল। সেখানে অনেকেই ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস করল সকালে তো তার যাবার কথা ছিল। ব্রাহ্মণ জানাল, সেইই যাচ্ছিল কিন্তু এক মন্ত্রসিদ্ধ মহর্ষি তার কষ্ট শুনে তার বদলে চলে যায়। সম্ভবত সেই মহর্ষিই নিশ্চয়ই এই রাক্ষসের বধ করেছে।

তথ্যসূত্র


  1. "মহাভারত সারানুবাদ", দেবালয় লাইব্রেরী(প্রকাশক সৌরভ দে, তৃতীয় প্রকাশ) - রাজশেখর বসু, আদিপর্ব (২৮। একচক্রা বকরাক্ষস  পৃষ্ঠাঃ ৬৩ -৬৫)
  2. "কৃষ্ণা, কুন্তী ও কৌন্তেয়", আনন্দ পাবলিশার্স, নবম মুদ্রণ - নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, অধ্যায়ঃ ভীম, পৃষ্ঠাঃ ১৮৫- ১৮৭
  3. https://en.wikipedia.org/wiki/Bakasura
  4. https://www.bongodorshon.com/home/story_detail/sati-pit-birbhum

আপনার মতামত জানান