অ্যান্টনি ল্যান্সলট ডায়াস

অ্যান্টনি ল্যান্সলট ডায়াস

ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে দক্ষ প্রশাসক এবং সংগঠকের তালিকায় যাঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে, সেই তালিকার একেবারে উপর দিকে নিঃসন্দেহে স্থান পাবে অ্যান্টনি ল্যান্সলট ডায়াস (Anthony Lancelot Dias) তথা এ. এল. ডায়াসের নাম। গোয়ার একজন দক্ষ ভারতীয় সিভিল সার্ভিস অফিসার ছিলেন তিনি। পর্তুগিজ শাসিত গোয়ার স্বাধীনতার লড়াইতেও উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল অ্যান্টনির। ব্রিটিশ ভারতে বেড়ে ওঠা অ্যান্টনির সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এমন কিছু অধ্যায় রয়েছে যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। ষাটের দশকের খাদ্যাভাব, বিহারের খরা পরিস্থিতি থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে তাঁর জীবন প্রবাহিত হয়েছিল। মহারাষ্ট্র এবং বম্বে প্রদেশের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদের দায়িত্ব সামলেছেন অ্যান্টনি, কেন্দ্রীয় খাদ্যসচিব হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, আবার ১৯৭১ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের পদও অলঙ্কৃত করেছেন তিনি। ষাটের দশকে বিহারের খরায় অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে কাজ করা এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ভারত সরকার তাঁর সেই কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭০ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মানে ভূষিত করে অ্যান্টনি ল্যান্সলট ডায়াসকে।

১৯১০ সালের ১৩ মার্চ গোয়ার আশাগাঁও গ্রামে গোয়ান বংশোদ্ভূত অ্যান্টনি ল্যান্সলট ডায়াসের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম এরাসমো ডায়াস (Erasmo Dias) এবং মায়ের নাম ছিল হারমিনিয়া ডায়াস (Herminia Dias)। অ্যান্টনির দুই বোনের নাম যথাক্রমে সিলভিয়া দাগামা এবং ফ্লোরি ডায়াস। এছাড়াও অ্যান্টনির এক ভাই ছিল যার নাম অ্যালোসিয়াস ডায়াস। পরবর্তীকালে অ্যান্টনি প্রথম গোয়ান বংশোদ্ভূত আইসিএস জোসেফ অ্যান্টনি ভাসের কন্যা জোয়ানকে বিবাহ করেন। জোয়ানের জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গ হওয়ার সুবাদে অ্যান্টনি ডায়াস পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হওয়ার সময় জোয়ান খুবই আহ্লাদিত হন। জোয়ান নিজের উদ্যোগে সল্টলেকে এসওএস গ্রাম তৈরির পরিকল্পনা করেন এবং তাঁর পরিচালনায় একটি সুদক্ষ দল কর্তৃক সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটে। এই কাজে জোয়ানকে সাহায্য করেছিলেন তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী ভোলা সেন। অ্যান্টনি এবং জোয়ানের চার কন্যার নাম যথাক্রমে  রাওয়েনা, নোয়েলা, লায়লা এবং মেরি। 

পুনের সেন্ট ভিনসেন্ট স্কুল থেকে বিদ্যালয় স্তরের শিক্ষা সমাপ্ত করবার পর অ্যান্টনি পুনেরই ফার্গুসন কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর আরও উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন এবং ‘লণ্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্‌স’-এ অধ্যয়ন শুরু করেন। অর্থনীতি বিষয়ে অসামান্য প্রতিভার পরিচয় দেওয়ার ফলে তিনি লণ্ডন কোবডেন ক্লাব গোল্ড মেডেল এবং হিউ লুইস পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। তারপর ইণ্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সফলতা অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন। গোয়ার পর্তুগিজ মহলের বাসিন্দা হলেও তিনি মুম্বই ক্যাডারের (বর্তমানে মহারাষ্ট্র ক্যাডার) সিভিল সার্ভিস অফিসার হিসেবে যোগদান করেছিলেন। ১৯৬৯ সালে অবসর গ্রহণের আগে পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন। 

বম্বেতে একজন কালেক্টর হিসেবে কেরিয়ার শুরু করেছিলেন অ্যান্টনি। একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তিনি বম্বে প্রেসিডেন্সি এবং মহারাষ্ট্রের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব সামলেছিলেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। স্বাধীনতার পর ভারতবর্ষের একটি পৃথক প্রদেশ হিসেবে পরিচিত হয়েছিল মহারাষ্ট্র। এরপরে একাদিক্রমে ভূমি রেকর্ডের ডিরেক্টর এবং সেটলমেন্ট কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অ্যান্টনি। যে জটিল ‘শিপ-টু-মাউথ’ প্রোগ্রাম ভারতের জলসরবরাহ ব্যবস্থাকে সচল রাখে, বম্বে পোর্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি সেই প্রোগ্রামের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত মহারাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রসচিবের পদেও আসীন ছিলেন তিনি। এরপর অ্যান্টনি ল্যান্সলট ডায়াস চলে যান দিল্লিতে। সেই ১৯৬০-এর দশকের শেষদিকে দেশজুড়ে খাদ্য ঘাটতির সমস্যা দেখা দিয়েছিল ভয়ঙ্কররূপে। সেই সময় অ্যান্টনি ল্যান্সলট ডায়াস খাদ্যসচিব হিসেবে এই শোচনীয় অবস্থায় অসামান্য কাজ করেছিলেন। তবে এইসময় তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং অভাবনীয় কাজ ছিল ১৯৬৬ সালে বিহারে যে ভয়ঙ্কর খরা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল, সেখানে তিনি প্রায় ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। খাদ্যসচিব ছাড়াও অ্যান্টনি বেসামরিক সরবরাহ, শিক্ষা এবং কৃষিসচিব হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৬৯ সালে সরকারি খাতে জনগণের জন্য আধুনিক মানের বেকারি নির্মাণেও প্রধান কাণ্ডারি ছিলেন অ্যান্টনি। পর্তুগিজদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গোয়ার যে স্বাধীনতার লড়াই ১৯৬১ সালে অ্যান্টনি ল্যান্সলট সেই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। 

১৯৬৯ সালে অবসর গ্রহণের পরে তিনি ত্রিপুরার লেফটেন্যান্ট গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন। এরপর ইন্দিরা গান্ধী এ. এল. ডায়াসকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসেবে নিযুক্ত করেন। এই প্রথমবার গোয়ান বংশোদ্ভূত কোন ব্যক্তি ভারতবর্ষের একটি রাজ্যের রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব পেলেন। ১৯৭১ সালের ২১ আগস্ট থেকে অ্যান্টনি পশ্চিমবঙ্গের অষ্টম রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সমসময়ের অনেক মানুষ পরবর্তীকালে বলেছিলেন যে পদ্মজা নাইডুর পর আবার এমন একজন রাজ্যপাল এলেন যে রাজভবনের পরিবেশই প্রায় বদলে গিয়েছিল। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই যে দুটি জটিল সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল অ্যান্টনিকে সেগুলির একটি হল চরমপন্থী বাম রাজনীতি অর্থাৎ নকশালপন্থী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়া অশান্তি এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী আগমন। অ্যান্টনি ল্যান্সলট ডায়াস এবং তাঁর স্ত্রী জোয়ান ডায়াস দুজনেই খুব সহৃদয় এবং জনদরদী মানুষ ছিলেন। দীর্ঘদিন দার্জিলিঙে থাকাকালীন সমস্ত প্রকাশ্য জমায়েতে অংশগ্রহণ করতেন তাঁরা, মানুষের সমস্যা শুনতেন এবং সমাধানের চেষ্টা করতেন। একজন রাজ্যপাল মানে তিনি যে একইসঙ্গে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিরও আচার্য সেকথা একেবারেই ভোলেননি অ্যান্টনি। বরং রাজ্যে শিক্ষার অগ্রগতি এবং ছাত্রছাত্রীরা যাতে উন্নতমানের শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেতে পারে সেজন্যে নিরলস পরিশ্রম এবং নানারকম উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর গলদ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বললে খুব গুরুত্ব সহকারে তা শুনতেন তিনি। রাজ্যের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকল্পে অ্যাকাডেমিক বডির অবস্থা, অ্যাকাডেমিক বিভিন্ন প্রোগ্রামের বাস্তুবায়ন ইত্যাদি বিষয়ে পর্যায়ক্রমিকভাবে তাঁর কাছে রিপোর্ট জমা দিতে। তিনি ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট বা এনবিটির চেয়ারম্যান পদেও বেশ কিছুদিন কাজ করেছেন। এছাড়াও ১৯৭০ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ওটোয়ার ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার’-এর গভর্নর বোর্ডের সদস্যপদ অলঙ্কৃত করেছিলেন অ্যান্টনি। কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি নয়, ভারতীয় জাদুঘরের বোর্ড অফ ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি নানারকম সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন অন্তর্বর্তী বিশৃঙ্খলা এবং অনিয়ম দূর করবার জন্য। ঐতিহ্যশালী ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ব্যবস্থাপনা এবং সংস্কারের ক্ষেত্রেও তিনি এমনই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বোর্ড অফ ট্রাস্টিজেরও চেয়ারম্যান ছিলেন অ্যান্টনি ল্যান্সলট ডায়াস। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতি বসু অ্যান্টনি ল্যান্সলট ডায়াসের অধীনেই শপথ বাক্য করেছিলেন। পড়াশোনায় অসম্ভব আগ্রহ ছিল অ্যান্টনির। অধ্যাপক এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল নুরুল হাসানের পর রাজভবনে সবেচেয়ে বেশি বইয়ের সংগ্রহ ছিল অ্যান্টনি ল্যান্সলটের। এছাড়াও ভারতবর্ষের ধনী ব্যক্তিদের তালিকাতেও এককালে তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল।

১৯৬৬ সালে বিহারের ভয়ঙ্কর খরা পরিস্থিতিকে দক্ষ হাতে সামাল দেওয়ার অনবদ্য কৃতিত্বকে সম্মান জানিয়ে ভারত সরকার অ্যান্টনি ল্যান্সলট ডায়াসকে ১৯৭০ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মানে ভূষিত করে। 

২০০২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর রবিবার ৯২ বছর বয়সে মুম্বাই শহরে অ্যান্টনি ল্যান্সলট ডায়াসের মৃত্যু হয়। 

আপনার মতামত জানান