অখিল নিয়োগী

অখিল নিয়োগী

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক অখিল নিয়োগী (Akhil Niyogi)। তিনি মূলত ‘স্বপনবুড়ো’ ছদ্মনামেই সকলের কাছে পরিচিত ও বিখ্যাত হয়েছিলেন। তাঁর শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা রচনাগুলির মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য হল ‘বেপরোয়া’ যা প্রথমে ধারাবাহিকভাবে ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হত। ছাত্রজীবনে শিক্ষক হিসেবে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যে এসেছিলেন অখিল নিয়োগী । কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও পরবর্তীকালে চলচ্চিত্র পরিচালনা, ছবি আঁকা এমনকি গানও লিখেছিলেন তিনি। ‘সব পেয়েছির আসর’ গড়ে তোলার পিছনে তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে শ্রীনিকেতনের উপর একটি তথ্যচিত্রের চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন অখিল নিয়োগী ।

১৯০২ সালের ২৫ অক্টোবর অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল মহকুমার অন্তর্গত সাঁকরাইল গ্রামে অখিল নিয়োগীর জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম অখিলবন্ধু নিয়োগী। তাঁর বাবার নাম গোবিন্দচন্দ্র নিয়োগী এবং মায়ের নাম ভবতারিণী দেবী। তাঁর বাবা পেশায় ছিলেন স্থানীয় বিন্দুবাসিনী হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। সাঁকরাইল গ্রামেই তাঁর মামা কবিরাজ যদুনাথ সেনগুপ্তের কাছে মানুষ হয়েছিলেন অখিল নিয়োগী । শৈশবে অবাধে পল্লী প্রকৃতির অঙ্গনে ঘুরে বেড়ানো, সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে চড়ুইভাতি, নৌকা করে খাল-বিল পেরিয়ে অজানা জায়গায় চলে যাওয়া, রাত জেগে যাত্রাগান শোনা সব মিলিয়ে পূর্ববঙ্গের পল্লী প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর এক নিবিড় যোগসূত্র গড়ে উঠেছিল। কিশোর বয়সে সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে গ্রামে পাঠাগারও স্থাপন করেছিলেন তিনি।

গ্রামের পাঠশালায় গুরুমশাই তীর্থবাসী পণ্ডিতের কাছে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। পরে যদিও তিনি কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিজ্ঞান পড়ার জন্য তিনি সিটি কলেজে ভর্তি হন। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই আই.এস.সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন অখিল নিয়োগী। তারপর বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চশিক্ষার পরিবর্তে তিনি ভর্তি হন তৎকালীন গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল অখিলের। এই আর্ট স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ সালে এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয় অখিল নিয়োগীর লেখা ‘বাঘমামা’, ‘পরীর দৃষ্টি’ ও ‘স্বপ্নপুরী’ নামের লেখাগুলি। আর্ট স্কুলে শিক্ষক হিসেবে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পেয়েছিলেন তিনি। তাছাড়া এখানে পড়ার সময় ‘আর্টিস্ট ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’-র প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন তিনি। এই সোসাইটির পক্ষ থেকে ‘চিত্রা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করা হত। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উৎসাহেই ১৯২৮ সালে ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম কিশোর উপন্যাস ‘বেপরোয়া’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। পরে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এবং এই লেখাটিই তাঁকে বাংলার সাহিত্য-অঙ্গনে শিশু সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত করে তোলে।

কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে অখিল নিয়োগীর কর্মজীবন শুরু হয় । পরে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে অঙ্কনশিল্পী হওয়ার সুবাদে। পরবর্তীকালে ‘খেয়া’, ‘ছোটদের মাসিক পত্রিকা’ ইত্যাদি পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা করতে শুরু করেন তিনি। ছোটদের জন্য গল্প, ছড়া, নাটিকা, উপন্যাস রচনা করেছেন তিনি। এমনকি বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য বহু গানও লিখেছিলেন অখিল। তাঁর লেখা সেইসব গানের রেকর্ডেই তিনি প্রথম ‘স্বপনবুড়ো’ এই নামটি ব্যবহার করেন। এই নামে প্রথম একটি রূপক নাটিকা মুক্তি পায় শিশু-কিশোরদের মধ্যে প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে আর এই নাটিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি নিজেই। ‘স্বপনবুড়ো’ চরিত্রটিকে তিনি এমনভাবে এঁকেছিলেন বিজ্ঞাপনে যে তা সহজেই শিশুদের আকৃষ্ট করেছিল। অদ্ভুত দাড়ি, নাকের উপর ঝুলে পড়া চশমা, চোলা হাতাওয়ালা বিচিত্র জামা পরিহিত স্বপনবুড়ো সেই সময় থেকেই শিশু সাহিত্যের জগতে আইকন হয়ে ওঠেন। ১৯৪২ সালে বিখ্যাত দৈনিক সংবাদপত্র ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় ‘ছোটদের পাততাড়ি’ নামে একটি শিশু বিভাগ চালু হয় এবং ১৯৪৫ সালের মে মাসে ঐ বিভাগের সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন অখিল নিয়োগী। ১৯৪৫ সাল থেকেই ‘সব পেয়েছির আসর’ নামে একটি শিশু-কিশোর সংস্থা গড়ে তোলেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের ভিতরে এবং বাইরে নানা অঞ্চলের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এই সংস্থার শাখা গড়ে তুলেছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালে উড়িষ্যার কটক শহরে ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয় যেখানে শিশু সাহিত্য শাখার সভাপতিত্ব করেন অখিল নিয়োগী। এই বছরই ‘আন্তর্জাতিক শিশুরক্ষা সমিতি’র দ্বারা আমন্ত্রিত হয়ে তিনি ভিয়েনা এবং ইউরোপে ভ্রমণ করেন। এই বইটি তাঁর লেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমণকাহিনী। ‘সব পেয়েছির আসর’ সংস্থার সম্পাদক থাকাকালীন ‘মুক্তির বন্ধনে’ নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন অখিল নিয়োগী। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালেই শ্রীনিকেতনের উপরে একটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয় যার চিত্রনাট্য লিখেছিলেন তিনি।

১৯৫৬ সালে শ্রেষ্ঠ শিশু সাহিত্যিক হিসেবে ফটিক স্মৃতি পদকে ভূষিত হন অখিল নিয়োগী। এছাড়া ১৯৮৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ দিয়ে সম্মানিত করে।

তাঁর লেখা শিশু-কিশোর উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘বাবুইবাসা বোর্ডিং’, ‘বনপলাশীর ক্ষুদে ডাকাত’, ‘বাস্তুহারা’, ‘পঙ্ক থেকে পদ্ম জাগে’, ‘ধন্যি ছেলে’, ‘কিশোর অভিযান’, ‘পালা পার্বণ ছড়া-ছন্দ’, ‘ভুতুড়ে দেশ’, ‘খেলার সাথী’ ইত্যাদি। এছাড়া ছোটদের জন্য লেখা নাটিকাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘বাসন্তিকা’, ‘নীলকণ্ঠ পাখী’, ‘সোনার কাঠি’, ‘ফুলপরী’, ‘দুর্যোধনের দুষ্টুমি’, ‘ওলট-পালট’ ইত্যাদি। এছাড়াও শর্ম্মিষ্ঠা ও দেবযানী’ নামে একটি নৃত্যনাট্যও লিখেছিলেন অখিল নিয়োগী।

১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় অখিল নিয়োগীর মৃত্যু হয়।

তথ্যসূত্র


  1. অসিতাভ দাশ (সম্পা:), 'স্বপনবুড়ো রচনাবলী', ১ম খণ্ড, প্রভা প্রকাশনী, মুখবন্ধ ও সম্পাদকের কথা  
  2. https://www.chharpatra.com/
  3. https://www.youtube.com/
  4. https://en.wikipedia.org/

2 comments

আপনার মতামত জানান